আইন-আদালত

বিয়ের প্রলোভনে ‌‘ধর্ষণ’: পুরুষ হয়রানি বৃদ্ধির শঙ্কা

বিয়ের প্রলোভনে ‌‘ধর্ষণ’: পুরুষ হয়রানি বৃদ্ধির শঙ্কা

নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে অন্তর্বর্তী সরকার থেকে বেশকিছু আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় ধর্ষণের সংজ্ঞা সংশোধন এবং বিয়ের প্রতিশ্রুতি বা প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধ যৌনকর্মের সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর রেখে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আর এ অপরাধের বিচার হবে পৃথক ধারায়। অনুমোদিত খসড়ায় শিশু ধর্ষণ অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বলাৎকারকে ধর্ষণের আওতায় নিয়ে বিচার হবে সংশোধিত আইনে। অনুমোদিত খসড়ায় ধর্ষণের মামলার তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে আনা হচ্ছে।

Advertisement

গত ২০ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। এরপর তা নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট আবেদনও করা হয়েছে। এখনো সেটির ওপর শুনানি হয়নি। শুনানি হলে আদালতের কী সিদ্ধান্ত আসে সেটার দিকে তাকিয়ে সবাই।

এই সংশোধনীর ফলে ছেলেরা অপরাধ করলে সহজে ধরা পড়বে এবং এতে মামলা সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। তাই যে কোনো সম্পর্ক করার আগে চিন্তা ভাবনা করা উচিত হবে। সম্পর্ক ট্র্যাফিক লাইটিংয়ের মতো চলতে শুরু করবে। সম্পর্কের নামে অসামাজিক কাজ বন্ধ হবে। আবার যেকোনো সময় মামলা হবে এবং বিচারও হয়ে যাবে। মানুষ নিজের মতামত সম্পর্কেও সচেতন হবে। যত্রতত্র জড়িয়ে যাবে না। সমাজ শুদ্ধ হবে। —ফওজিয়া করিম

তারপরও বিয়ের প্রলোভন বা প্রতিশ্রুতিতে সাত বছর সাজাসহ সংশোধিত আইন নিয়ে আইনজীবী, শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া গেছে। আইনজীবীদের কারও মতে, বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে শারীরিক সম্পর্ককে শাস্তির আওতায় আনা ভুল। কারও মতে, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে বিয়ের প্রলোভন বা প্রতারণার মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্ককে লঘু অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক।

Advertisement

আরও পড়ুন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধনী পাস  হঠাৎ ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে কেন? কী করছে পুলিশ? 

মানবাধিকার কর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফওজিয়া করিম ফিারোজ জাগো নিউজকে বলেন, বিয়ের প্রতিশ্রুতি বা প্রলোভনে বিষয়ে যেটা বলা হয়েছে, সেটাকে অত্যন্ত লঘু অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বিষয়টিকে কম গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। অপরাধটাকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। এই সংশোধনীর ফলে ছেলেরা অপরাধ করলে সহজে ধরা পড়বে এবং এতে মামলা সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। তাই যেকোনো সম্পর্ক করার আগে চিন্তা ভাবনা করা উচিত হবে। সম্পর্ক ট্র্যাফিক লাইটিংয়ের মতো চলতে শুরু করবে। সম্পর্কের নামে অসামাজিক কাজ বন্ধ হবে। আবার যেকোনো সময় মামলা হবে এবং বিচারও হয়ে যাবে। মানুষ নিজের মতামত সম্পর্কেও সচেতন হবে। যত্রতত্র জড়িয়ে যাবে না। সমাজ শুদ্ধ হবে।

আরও পড়ুন কঠোর শাস্তির বিধান কি ধর্ষণ প্রবণতা কমাবে?  সব দোষ পুরুষের 

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, তাড়াহুড়ো করে আইনটিতে সংশোধনীতে আনা হচ্ছে। আরেকটু সময় নিয়ে, বিশ্লেষণ করলে মনে হয় ভালো হতো।’

মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদ-ছবি জাগো নিউজ

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ মনে করেন, বিদ্যমান বাস্তবতায় বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের কারণে সাত বছরের সাজার বিধান রাখা যৌক্তিক।

Advertisement

প্রাপ্তবয়স্ক দুজন নারী-পুরুষ সম্পর্কে জড়ানোর পর সম্মতির মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্ক হয়। কিন্তু কয়েক বছর পর যেকোনো কারণে মনোমালিন্য হলে এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে মামলার বহু উদাহরণ রয়েছে। মামলাগুলো প্রমাণ করা যদিও কঠিন। এখন বিয়ে বা অন্য প্রলোভনে ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে তো আসামিকে ফাঁসি দেওয়া যায় না। এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে ফাঁসি দিলে তা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি হবে। —মনজিল মোরসেদ

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাজার হাজার মামলা হয় ধর্ষণের। কিন্তু সব ধর্ষণ মামলা কিন্তু মাগুরার সেই শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার মতো নয়। মাগুরায় ওই ঘটনায় আসামিদের ফাঁসির দণ্ডের দাবি যৌক্তিকভাবেই উঠছে এবং এটাই স্বাভাবিক।’

আরও পড়ুন মাগুরায় যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুটি মারা গেছে  ধর্ষণের বিরুদ্ধে মহিলা জামায়াতের মানববন্ধন, ৫ দফা দাবি 

তিনি বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক দুজন নারী, পুরুষ সম্পর্কে জড়ানোর পর সম্মতির মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্ক হয়। কিন্তু কয়েক বছর পর যেকোনো কারণে মনোমালিন্য হলে এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে মামলার বহু উদাহরণ রয়েছে। মামলাগুলো প্রমাণ করা যদিও কঠিন। এখন বিয়ে বা অন্য প্রলোভনে ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে তো আসামিকে ফাঁসি দেওয়া যায় না এবং এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে ফাঁসি দিলে তা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি হবে। আমার মনে হয় আইনের এ বিধানটি যৌক্তিক।

বিবাহের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণের আওতাভুক্ত করা চরম ভুল এবং আইনের মূলনীতির পরিপন্থি। ধর্ষণের ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় হলো সম্মতি। বিবাহের প্রলোভনের নামে শারীরিক সম্পর্ক এবং পরে বিবাহে অস্বীকৃতি বড়জোর প্রতারণার অপরাধ হতে পারে, কোনোমতেই ধর্ষণ নয়। —জ্যোতির্ময় বড়ুয়া

সংশোধনী নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ২০ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধনী-সংক্রান্ত খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে কেবিনেট (উপদেষ্টা পরিষদ)। সংশোধনীতে যথেচ্ছ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখার ফলে মামলার বিচার ঝুলে যাবে।

ধর্ষকের সাজার দাবিতে প্রথমবারের মতো সড়কে মহিলা জামায়াত-ছবি জাগো নিউজ

তিনি বলেন, ‘বিবাহের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণের আওতাভুক্ত করা চরম ভুল এবং আইনের মূলনীতির পরিপন্থি। ধর্ষণের ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় হলো সম্মতি। বিবাহের প্রলোভনের নামে শারীরিক সম্পর্ক এবং পরে বিবাহে অস্বীকৃতি বড়জোর প্রতারণার অপরাধ হতে পারে, কোনোমতেই ধর্ষণ নয়। এখানে জোরজবরদস্তির অনুপস্থিতি মামলা প্রমাণের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক হবে।’

সংশোধনী নিয়ে মানবাধিকার কর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান জাগো নিউজকে বলেন, আমি মনে করি দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তাদের মধ্যে বিয়ের প্রতিশ্রুতি হলো কি হলো না, তারা যদি নিজেদের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্কে জড়ায় তাহলে সেটাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া, তাও শুধু একটি পক্ষকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। এই আইন পাস হলে সমাজে ব্লাকমেলিং বেড়ে যাবে, হানাহানি বেড়ে যাবে।

আমি মনে করি দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তাদের মধ্যে বিয়ের প্রতিশ্রুতি হলো কি হলো না, তারা যদি নিজেদের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্কে জড়ায় তাহলে সেটাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া, তাও শুধু একটি পক্ষকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। এই আইন পাস হলে সমাজে ব্লাকমেলিং বেড়ে যাবে।—ইশরাত হাসান

সংশোধিত আইনের প্রায়োগিক দিকগুলোর ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরে অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, এই আইনের ফলে অফিসের নারী সহকর্মী তার বসের বিরুদ্ধে, নারী মক্কেল তার আইনজীবীর বিরুদ্ধে, ছাত্রী তার শিক্ষকের বিরুদ্ধে- এভাবে যেকোনো নারী এই আইনকে ব্যবহার করে আদালতে বা থানায় নারী নির্যাতনের মামলা করতে পারবে। অনেক নারী এই আইনকে টাকা আয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। কারণ, নারীর পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না প্রকাশ হবে আসামির পরিচয়। ফলে, দুষ্কৃতকারীরা আড়ালে থেকে এই মামলাকে তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করতে পারবে। এতে থানায় থানায় চলতে পারে মামলা বাণিজ্য।

আরও পড়ুন বাংলাদেশে ধর্ষকদের কোনো স্থান হবে না: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা  হেলিকপ্টারে মাগুরার পথে শিশুটির নিথর দেহ 

২০২৫–এর অধ্যাদেশে ধারা ৯ (খ) নামের একটি নতুন ধারা সংযোজনের মাধ্যমে বলা হয়েছে, প্রণয়ের সম্পর্ক থাকাকালে বিয়ের প্রলোভন বা অন্যবিধ প্রতারণার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি যদি ১৬ বছরের অধিক বয়সী কোনো নারীর সঙ্গে যৌনকর্ম করেন, তাহলে সেই যৌনকর্ম ‘ধর্ষণ’ বলে বিবেচিত হবে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির ‘অপরাধ’ প্রমাণিত হলে অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।

এটি একটি সমস্যাযুক্ত ধারা। কারণ, যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ থেকে আলাদা করা হয় কেবল ‘সম্মতি’ নামক শর্তটি দিয়ে। এ ক্ষেত্রে অপরাধটিকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে বিয়ের সম্পর্ক বা প্রেমের সম্পর্ক আছে বা ছিল কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আগে ঘটিত কোনো ধর্ষণের অপরাধকে পরবর্তী সময়ে বিয়ের মাধ্যমে যেমন জায়েজ করা যায় না, ঠিক তেমনি প্রণয়ের সম্পর্কে সম্মতিসহ স্থাপিত যৌন সম্পর্ক পরবর্তী সময়ে ধর্ষণ হয়ে যায় না। এটি খুবই সরল একটি বিষয়।—উম্মুল ওয়ারা

সংশোধনী নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক উম্মুল ওয়ারা বলেন, এটি একটি সমস্যাযুক্ত ধারা। কারণ, যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ থেকে আলাদা করা হয় কেবল ‘সম্মতি’ নামক শর্তটি দিয়ে। এ ক্ষেত্রে অপরাধটিকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে বিয়ের সম্পর্ক বা প্রেমের সম্পর্ক আছে বা ছিল কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আগে ঘটিত কোনো ধর্ষণের অপরাধকে পরবর্তী সময়ে বিয়ের মাধ্যমে যেমন জায়েজ করা যায় না, ঠিক তেমনি প্রণয়ের সম্পর্কে সম্মতিসহ স্থাপিত যৌন সম্পর্ক পরবর্তী সময়ে ধর্ষণ হয়ে যায় না। এটি খুবই সরল একটি বিষয়।

সড়কে সোচ্চার ছাত্রদল-ফাইল ছবি

আরও পড়ুন ধর্ষণের বিচার না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকবে ছাত্রদল  ধর্ষকের ফাঁসি দাবিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ 

তিনি বলেন, এটিকে বর্তমান অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত করে পুরুষদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে বলে মনে করি। কারণ, বিয়ের সম্পর্ক তালাকের মাধ্যমে শেষ করে দেওয়ার অধিকার থাকলেও প্রণয়ের সম্পর্ক শেষ করার অধিকার এখন আর কোনো পুরুষের থাকলো না। কেননা, নারীসঙ্গী যেকোনো সময় মামলা করে বলতে পারেন, তিনি বিয়ের প্রলোভনে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। অথচ অন্যদিকে আমাদের ১৮৬১ সালের দণ্ডবিধির ধারা ৩৭৫–এ ধর্ষণের যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে, তা ‘ম্যারিটাল রেপ’বা বৈবাহিক ধর্ষণকে স্বীকৃতি দেয় না। এটাই সবার আগে পরিবর্তন করা উচিত ছিল।

এফএইচ/এসএইচএস/জিকেএস