ফিচার

কেমন ছিল সত্তর দশকের নববর্ষ

কেমন ছিল সত্তর দশকের নববর্ষ

রওশন আরা বেলীসত্তরের দশকের কথা; ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। আমার মতো গ্রাম-বাংলার শিশুদের তখনও আনন্দ র‌্যালি বা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের বিষয়ে কোন ধারণা নেই। তখন আমাদের কাছে বাংলা নতুন বছর মানে ছিল হালখাতা।

Advertisement

বৈশাখের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা পুরোনো বছরের হিসাব-নিকাশ মিটিয়ে হিসেবের নতুন খাতা খুলতেন। এটা রীতিমতো উৎসবে রূপ নিলো। বিশেষ করে হালখাতার পথচেয়ে থাকতো এলাকার শিশুরা। সে আগ্রহের সঙ্গে খাতার হিসেবের কোন সম্পর্ক নেই। বাচ্চারা চেয়ে থাকতো বুন্দিয়া-লুচির একটি প্যাকেটের দিকে।

চৈত্র সংক্রান্তির আগেই বাড়ি বাড়ি হালখাতার চিঠি বিলি করতেন দোকানীরা। মূলত মুদির দোকান আর কাপড়ের দোকান। প্রায় প্রতিটি মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার সারা বছর এই দুই ধরনের দোকানে কিছু না কিছু বাকিতে নিতো। বছরের প্রথম দিনে সেই ধার পরিশোধ করে নতুন খাতা খোলার জন্য দাওয়াত আসতো বাড়িতে।

হালখাতার চিঠি হাতে নববর্ষের প্রথম সকালে বাবা দোকানে যেতেন। ফিরতেন লুচি, বুন্দিয়া আর রসগোল্লার প্যাকেটে নিয়ে। আমরা ভাই-বোনেরা সারাদিন এগুলোর অপেক্ষায় থাকতাম। এই লুচি-মিষ্টি খেতে পাবার আনন্দই ছিল আমাদের তখনকার বর্ষবরণ। দুই-তিনটি দোকান থেকে এত মিষ্ট, লুচি বাড়িতে আসতো যে, সে রাতে বাড়িতে কিছু ভালো রান্না হলে পেটে আর জায়গা থাকতো না। আমাদের বাড়িটি বাজার-লাগোয়া হওয়ার কারণে দিনভর যে দোকানগুলোতে মিষ্টি তৈরি হতো, বাড়ি থেকে তার গন্ধ পেতাম, আর মাঝে মাঝে এক দৌড়ে দেখেও আসতাম।

Advertisement

এমন ছিলো সত্তরের দশকে বাংলার গ্রাম ও মফস্বলের পহেলা বৈশাখ বা পয়লা বৈশাখ। বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাসের এক তারিখ, বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। দিনটি সব বাঙালি জাতির জন্যই ঐতিহ্যবাহী একটি দিন। অঞ্চলগত ও সাংস্কৃতিক কারণে উদযাপনের ধরন ও রীতিতে বরাবরই পার্থক্য ছিলো। আজও আছে। তাই তো এই পাঁচ দশক পরেও সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে উদযাপন করে যাচ্ছি এই নববর্ষের উৎসব।

সামাজিক জীবনে নতুন বছরকে আনন্দ উৎসবে বরণ করা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মানুষের জীবনযাত্রার অগ্রগতি ও নতুন চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে জীবনাচারের ধরন ও আঙ্গিক ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়, নতুন মাত্রা যোগ হয়, পুরোনো কিছু বিয়োগ হয়।

১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে, ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। তখন আমাদের স্কুলে বর্ষবরণের কোনো অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে না। মায়ের মুখে কয়েকবার চৈত্রসংক্রান্তির কথা শুনেছি। এরপর ১৯৮১-৮২ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর লালপাড় সাদাশাড়ি, মাথায় ফুল দিয়ে বিকেলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে আদর করে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গেয়ে যেভাবে নতুন বছরকে আহ্বান করেছি, তখন মনে হতো খুব আদর করে না ডাকলে বৈশাখ বুঝি আসবেই না! সেই আনন্দটা নতুন প্রাপ্তি মনে হতো, খুব ভালো লাগতো, নিজেদের সংস্কৃতির সৌন্দর্য, আনন্দ ও পরস্পরের সঙ্গে অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে নতুন বন্ধন তৈরি হতো।

তারপর থেকে এই অনুষ্ঠানের ধরনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। গ্রামীণ জীবন ও শহরের জীবনে আনন্দ উৎসবেরও কিছু ভিন্নতা আছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর পয়লা বৈশাখ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে গ্রমের মানুষের জীবনেও এর প্রভাব পড়তে থাকে। আজ সারাদেশে বিভিন্ন রঙিন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে এই দিনটি উদযাপন করা হচ্ছে গ্রাম, শহর ও মফস্বলে।

Advertisement

শহুরে হাওয়া গ্রামে পৌঁছানোর আগে মানুষ রাতের বেঁচে যাওয়া ভাতে পানি দিয়ে রেখে সকালে পেট ভরে পান্তা খেয়ে কাজে বের হতো। সেই পান্তা এখন বর্ষবরণের সকালের জনপ্রিয় খাবার, সঙ্গে বিভিন্ন ভর্তা, শুকনো লঙ্কাসহ আরও অনেক পদ। এর মধ্যে শহরের মানুষেরা ইলিশ মাছও চালু করেছে। তার মাঝে মুড়ি মুড়কির অংশগ্রহণও আছে।

এখন বাঙালি জাতির জীবনে নববর্ষ একটি ঐতিহ্য, আনন্দ, সংস্কৃতি ও প্রিয় খাবারে পরিপূর্ণ এক অনুষ্ঠান। কালে কালে উদযাপনের রূপ পাল্টেছে ঠিকই, কিন্তু এই উৎসব যে একান্তই বাঙালি জাতির নিজস্ব রীতি, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

এএমপি/আরএমডি/জেআইএম