বাঙালির যে কয়টি উৎসব আছে তার মধ্যে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠান। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি বয়সের মানুষ এই উৎসবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। গ্রামগঞ্জ তো বটেই নাগরিক জীবনেও জায়গা করে নিয়েছে এই উৎসব।
Advertisement
রমনার বটমূলে ছায়ানটের সুরে সঙ্গীতে বর্ষবরণের আয়োজন, চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই এক কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ বলে নববর্ষকে স্বাগত জানায়।
নানা রঙবেরঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে সব বয়সী মানুষজন অংশ নেয় এই উৎসবে। বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা। থাকে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার আয়োজন। সবমিলিয়ে এক অনাবিল আনন্দ উৎসবে মাতে এদিন পুরো বাঙালি জাতি।
বৈশাখে এখন কেনাকাটার ধুমও পড়ে যায়। সরকার বৈশাখী ভাতাও চালু করেছে উৎসবের গুরুত্ব বিবেচনায়। এটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে উৎসবে। এছাড়া বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায়। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে ইউনেস্কো লিখে: "মঙ্গল শোভাযাত্রা হল জনসাধারণের একটি উৎসব যা ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে (নববর্ষের দিনে) উদযাপন করা হয়, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দ্বারা আয়োজন করা হয়।
Advertisement
ঐতিহ্যটি ১৯৮৯ সালে শুরু হয়, যখন সামরিক শাসনের অধীনে বসবাসরত হতাশ শিক্ষার্থীরা সম্প্রদায়কে একটি উন্নত ভবিষ্যতের আশা দিতে চেয়েছিল। এটির বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে মুখোশ ও ভাসমান প্রতিকৃতি যা শক্তি, শান্তি এবং অগ্রগতির জন্য অশুভকে দূরে সরানোর প্রতীক। বিদ্যালয়ের দ্বারা ভাগভাগি করা জ্ঞানের উপাদানসহ, এটি জনসংহতি এবং গণতন্ত্রকে প্রচার করে।” মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ হওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের।
‘বাংলা সনের মূল নাম ছিল তারিখ-এ-এলাহী। মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৫ সালে তার রাজত্বকালের ২৯তম বর্ষের ১০ কিংবা ১১ মার্চ তারিখে এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে তারিখ-এ-এলাহী প্রবর্তন করেন। সিংহাসনে আরোহণের পরপরই তিনি একটি বৈজ্ঞানিক, কর্মপোযোগী ও গ্রহণযোগ্য বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, যেখানে দিন ও মাসের হিসাবটা যথাযথ থাকবে।
এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে তিনি তৎকালীন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমীর ফতুল্লাহ সিরাজিকে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরির দায়িত্ব প্রদান করেন। বিখ্যাত পণ্ডিত ও সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল এ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা প্রদান করেন যে, হিজরি বর্ষপঞ্জি কৃষিকাজের জন্য মোটেই উপযোগী ছিল না কারণ চন্দ্র বছরের ৩১ বছর হয় সৌর বছরের ৩০ বছরের সমান।
চন্দ্র বছরের হিসাবেই তখন কৃষকশ্রেণির কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হতো অথচ চাষবাসনির্ভর করতো সৌর বছরের হিসাবের ওপর। চন্দ্র বছর হয় ৩৫৪ দিনে আর সেখানে সৌর বছর হয় ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে। ফলে দুটি বর্ষপঞ্জির মধ্যে ব্যবধান থেকে যায় বছরে ১১ বা ১২ দিন। বাংলা সনের জন্ম ঘটে সম্রাট আকবরের এই রাজস্ব আদায়ের আধুনিকীকরণের প্রেক্ষাপটে।’ (সূত্র: উইকি পিডিয়া)
Advertisement
রাজধানীতে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ নববর্ষের আয়োজনে অংশ নেন। কিন্তু রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়া তেমন কোনো আয়োজন থাকে না। ফলে দিনভর মানুষজনের এলোপাতাড়ি ঘোরাঘুরি ছাড়া তেমন কিছু করার থাকে না। এজন্য বৈশাখের আয়োজন কীভাবে আরও বর্ণাঢ্য ও অংশগ্রহণমূলক করা যায় সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে যেন বাঙালির সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে পরিচিত করানো যায় এর আয়োজন থাকতে হবে।
সারাবিশ্বের অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও নাগরিক জীবনের এবং সরকারি কর্মকাণ্ডের সবকিছু চলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার হিসেবে। তারপরও বাঙালির গভীর মানসে বাংলা নববর্ষের স্থান অনেক উঁচুতে। বাঙালির মনপ্রাণজুড়ে রয়েছে বাংলা নববর্ষ। এদেশের কৃষক-শ্রমিক, জেলে-তাঁতি, কামার-কুমারসহ নানা পেশার মানুষ যুগ যুগ ধরে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে আসছে আনন্দ উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
ব্যবসায়ীরা এখনও হিসাবের নতুন খাতা ‘হালখাতা’ খোলেন বৈশাখের প্রথম দিনে। এজন্য মিষ্টান্নেরও আয়োজন থাকে। নববর্ষ উপলক্ষে দেশে গ্রামগঞ্জে নদীর পাড়ে, খোলা মাঠে কিংবা বটগাছের ছায়ায় মেলার আয়োজন করা হয়। দোকানিরা মুড়ি, মুড়কি, পুতুল, খেলনা, মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, বাঁশিসহ বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসের পসরা নিয়ে বসে। সত্যি বলতে কি বৈশাখী উৎসবের একটি অর্থনৈতিক দিকও আছে। সম্প্রদায় নির্বিশেষে উৎসবকেন্দ্রিক কেনাকাটা ও ব্যবসা-বাণিজ্যও ব্যাপক।
এভাবে বৈশাখ আসে আমাদের প্রাণের উৎসব হয়ে। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে এটি এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলা সনের উৎপত্তির সঙ্গে জড়িত এই দেশের মানুষের জীবনধারা এবং প্রকৃতির অবস্থার সঙ্গে ফসলের মৌসুম এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন তারিখ তথা পঞ্জিকার প্রবর্তন হলেও এ নববর্ষ উৎসব বাঙালির চিন্তা চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে। এটা এমন একটা উৎসব যাকে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীসহ সবাই সর্বজনীনভাবে প্রাণের আনন্দে বরণ করে নেয়।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এবার বৈশাখের আয়োজনেও ভিন্নতা এসেছে। এবার চাকমা, মারমা, গারোসহ দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশ গ্রহণে বৈশাখের উৎসব আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে-এমনটি বলা হচ্ছে। প্রথামাফিক রমনার বটমূলে ছায়ানটের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হবে সূর্যরাঙা বৈশাখের। এছাড়া মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ উৎসবের অন্য আনুষ্ঠানিকতা গুলো তো থাকছেই। যদিও এ বছর ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নাম পরিবর্তন করে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ করা হয়েছে।
রাজধানীতে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ নববর্ষের আয়োজনে অংশ নেন। কিন্তু রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়া তেমন কোনো আয়োজন থাকে না। ফলে দিনভর মানুষজনের এলোপাতাড়ি ঘোরাঘুরি ছাড়া তেমন কিছু করার থাকে না। এজন্য বৈশাখের আয়োজন কীভাবে আরও বর্ণাঢ্য ও অংশগ্রহণমূলক করা যায় সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে যেন বাঙালির সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে পরিচিত করানো যায় এর আয়োজন থাকতে হবে।
ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়ায় বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ অসুর দূর করে সুর সঙ্গীতের, মেলা ও মিলনের আনন্দ এবং উৎসবের, সাহস ও সংকল্পের। দুঃখগ্লানি, অতীতের ব্যর্থতা পেছনে ফেলে তাই এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেওয়ার দিনও পহেলা বৈশাখ। দেশের কল্যাণে সবাই এক কাতারে শামিল হয়ে এগিয়ে যাওয়ার অগ্নিশপথ নেওয়ার দিনও এটি।
পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও বৈশাখের চেতনায় সিক্ত হতে হবে। সব বাধাবিপত্তি ও বিধিনিষেধ উজিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। দূর করতে হবে সব কলুষতা। এবারের বৈশাখে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটুক।
সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। স্বাগত ১৪৩২ বঙ্গাব্দ।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ।drharun.press@gmail.com
এইচআর/জেআইএম