পয়লা বৈশাখে ‘হালখাতা উৎসব’ বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য। বকেয়ার টালি খাতার হিসাব চুকানোরও দিন এটি। দোকানে খরিদ্দারদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টিমুখ করানোর রেওয়াজও অনেক পুরোনো। তবে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে টালি খাতার জায়গা দখলে নিয়েছে কম্পিউটার বা নোটপ্যাড। ভাটা পড়েছে হালখাতার কার্ড ছাপানোর রেওয়াজ। ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে শতবর্ষী এই ‘হালখাতা উৎসব’।
Advertisement
ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা ও তার পরবর্তী গত কয়েক বছর রোজা, ঈদ এবং বাংলা নববর্ষ একই সঙ্গে হয়েছে। এরই মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহারও বেড়েছে। ফলে নববর্ষ ও নববর্ষকেন্দ্রিক উৎসবগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। কমেছে উৎসবমুখরতা। এর মধ্যে অন্যতম হালখাতা উৎসব। এ বছর হালখাতা করলেও নেই আগের মতো আমেজ।
শনি ও রোববার সরেজমিনে পুরান ঢাকার বাংলাবাজারে কার্ড তৈরি, শাঁখারীবাজারে পূজার সামগ্রী ও তাঁতীবাজারে জুয়েলারি দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায় এমন চিত্র। সেসব দোকানে আগের মতো নেই হালখাতা উৎসবের আমেজ।
সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন সবাই নগদ টাকায় কেনাকাটা করেন। বাকি বেচাকেনা, বন্ধক রাখা এসব কয়েক বছর ধরে বিলুপ্তপ্রায়। বকেয়া লেখার লাল কাপড়ের টালি খাতার ব্যবহার নেই বললেই চলে। হিসাব রাখা হয় মোবাইল ফোনের নোটপ্যাড কিংবা কম্পিউটারের এক্সেল শিটে। তাই কমে গেছে ঘটা করে হালখাতা উৎসবের আয়োজন।
Advertisement
বাংলাবাজারের এম. এ মান্নান প্রোডাক্ট কার্ড ছাপানোর দোকান। দোকানি শ্যামল চন্দ্র বলেন, আগের মতো আর হালখাতার কার্ড ছাপানো হয় না। তবুও এবছর হালখাতা উপলক্ষে কার্ড ছাপিয়েছি। কার্ডের জন্য এখনো তেমন কোনো অর্ডার পাইনি। বাংলার শতবর্ষী এ সংস্কৃতি এখন অনেকটাই বিলুপ্তপ্রায়।
আরও পড়ুন
ঐতিহ্যের সংক্রান্তি, হালখাতার প্রস্তুতিবাংলাবাজারের ভাই ভাই পেপার অ্যান্ড স্টেশনারির দোকানি আব্দুস সালাম বলেন, মানুষ এখন সবাই কম্পিউটারেই হিসাব লিখে রাখে। টালি খাতা তেমন ব্যবহার করে না। যারা একটু বড় ব্যবসায়ী তাদের মধ্যে দু-একজন লেখার জন্য খাতা ব্যবহার করেন। তবে ধীরে ধীরে তাদের পরিমাণও কমে আসছে।
শাঁখারীবাজারের পূজার সামগ্রীর দোকান লক্ষ্মী ভাণ্ডার। নববর্ষ উপলক্ষে এখানেও তেমন কোনো আমেজ লক্ষ্য করা যায়নি। দোকান মালিক কৃষ্ণ সাহা বলেন, বাংলা নববর্ষে এখন আর ঢাকঢোল পিটিয়ে হালখাতা করা হয় না। আগে আমরা দেখেছি, ঘটা করে পালন করা হতো নববর্ষ। থাকতো হালখতা উৎসব। এটি এখন বিলুপ্তপ্রায়। যারা পুরানো মানুষ, ঐতিহ্য রক্ষার জন্য তারা কয়েকজন করেন। এখন সবকিছু ডিজিটাল হয়ে গেছে। সে কারণে হালখাতার উৎসবমুখরতা কমে গেছে।
Advertisement
একই জায়গায় নন্দী অ্যান্ড কোং নামে রয়েছে আরও একটি পূজার সামগ্রী বিক্রির দোকান। দোকানি স্বপন নন্দী জানান, তারা এ বছর নববর্ষ উপলক্ষে হালখাতা আয়োজন করছেন না। অনেক আগে একসময় হালখাতা উপলক্ষে বেশ আয়োজন করা হতো।
তাঁতীবাজারের শরীফ জুয়েলার্সের দোকানি মাধব ধর স্বল্প পরিসরে নিয়েছেন হালখাতার প্রস্তুতি। পয়লা বৈশাখের দিন করবেন নববর্ষ উপলক্ষে হালখাতা। তিনি বলেন, একদিকে ঈদের খরচ, অন্যদিকে রোজা সবকিছু মিলিয়ে মানুষ টানাটানিতে জীবন পার করেছে। তবে আশা করি হালখাতা তুলনামূলক ভালো হবে।
ফারসি শব্দ ‘হাল’ এর অর্থ ‘নতুন’। ইতিহাসের দলিল পর্যালোচনা করে জানা যায়, ১৫৫৬ সালে মোগল সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি প্রজাদের খাজনা দিতে সমস্যার সমাধান করার জন্য নতুন সন প্রবর্তনের চিন্তাভাবনা শুরু করেন। ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবরের শাসন ক্ষমতা গ্রহণের সময় হিজরি সন ছিল ৯৬৩ সাল। আর এ বছর থেকেই তিনি হিজরি সনকেই সৌর সনে পরিবর্তিত করে বাংলা সন চালু করেন।
প্রথমে এই সালের নাম রাখা হয়েছিল ফসলি সন। পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর চৈত্র মাসের শেষ দিনে (চৈত্র সংক্রান্তি) জমিদারি সেরেস্তারা প্রজাদের কাছ থেকে কৃষি ও রাজস্ব কর বা খাজনা আদায় করতেন। এসময় প্রতি চৈত্র মাসের শেষদিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল বা কর পরিশোধ করা হতো। এর পরের দিন পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকেরা নিজেদের অঞ্চলের প্রজা বা অধিবাসীদের মিষ্টি, মিষ্টান্ন, পান-সুপারি প্রভৃতি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এটিই কালের পরিক্রমায় ‘হালখাতা’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
এমআইএন/এমকেআর/জেআইএম