খালেদ হোসাইন। বয়স চব্বিশ। হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার, চোখে ইউরোপে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন, আর সামনে একটি অনিশ্চিত পথ—নামের ওজন ‘ওয়েটিং পিরিয়ড’। তার মতো আরও হাজার হাজার তরুণ-তরুণী বাংলাদেশ থেকে পাড়ি জমাতে চান ইউরোপের উচ্চশিক্ষার অন্যতম গন্তব্য জার্মানিতে। কিন্তু আজ তাদের সেই স্বপ্ন আটকে আছে এক কঠিন বাস্তবতায়।
Advertisement
জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচিত। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় বিনা খরচে উচ্চশিক্ষার সুযোগ, আন্তর্জাতিক মানের কোর্স কারিকুলাম, গবেষণার উন্মুক্ত পরিবেশ, খণ্ডকালীন কাজের সুবিধা এবং সেমিস্টার ফিতে গণপরিবহনের সুবিধা—সব মিলিয়ে দেশটি অনেকের স্বপ্নের ঠিকানা। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি বাস্তবসম্মত গন্তব্য। কিন্তু বাস্তবতা এখন বলছে অন্য কথা।
প্রায় ৮০ হাজার স্বপ্ন আটকে আছে সিরিয়ালের ফাঁদে৭৯ হাজার ৮৮০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী জার্মানির ভিসার অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোস্টার। বুধবার (১২ মার্চ) নিজের এক্স হ্যান্ডেলে এক পোস্টে এ তথ্য জানান জার্মান রাষ্ট্রদূত।
২০২৪-২০২৫ (১২ মার্চ পর্যন্ত) সালে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা আবেদনের তালিকা তুলে ধরে এক্স হ্যান্ডেলে আখিম ট্রোস্টার জানান, ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে ১০ হাজার ৯৫৫ জন, দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১০ হাজার ৬৩৫, তৃতীয় প্রান্তিকে ১৬ হাজার ৪৬৯ এবং শেষ প্রান্তিকে ১৪ হাজার ৪৭৬ জন শিক্ষার্থী জার্মানির ভিসার জন্য আবেদন করেন।
Advertisement
এছাড়া, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত (১২ মার্চ) আবেদন জমা দিয়েছেন ৮ হাজার ৭৬২ জন শিক্ষার্থী। সব মিলিয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আবেদনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৯ হাজার ৮৮০।
রাষ্ট্রদূতের তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষার্থী স্টুডেন্ট ভিসার সিরিয়ালের অপেক্ষায় রয়েছেন। এটি শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, ৮০ হাজারটি জীবন, ভবিষ্যৎ এবং আশা। কিছু শিক্ষার্থী আছেন, যারা আড়াই বছর ধরে অপেক্ষা করছেন, তবুও কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাননি। এই তালিকায় মোহাম্মদ আসাদ রয়েছেন।
আরও পড়ুন জার্মানিতে পড়তে যাওয়ার আগে যা যা জানা প্রয়োজন যেভাবে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলেন রাশেদ উচ্চশিক্ষায় জার্মানিতে বিপুল সম্ভাবনাতিনি বলেন, ‘ভিসা পেতে ১৮-২০ মাস সময় লাগবে বলা হয়েছিল, এখন ৩০ মাস হয়ে গেছে। অথচ সেমিস্টার ফি, ডকুমেন্টেশন, অনুবাদ—সব মিলিয়ে লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। এই কি ছিল স্বপ্ন?’
আরও হতাশাজনক বিষয় হলো, নতুন আবেদনকারীদের জন্য এক ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে—সিরিয়ালের সময়কাল ৪০ বছর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে! এটা শুধু অবিশ্বাস্য নয় বরং এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতন।
Advertisement
উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণে অর্থের হিসেবও কম বড় বাধা নয়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ব্লক অ্যামাউন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৯০৪ ইউরোতে (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৬ লাখ)। অথচ এক বছর আগেও এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ২০৮ ইউরো। এই অর্থ ব্লকড অ্যাকাউন্টে জমা রাখতেই হবে, যেন প্রমাণ করা যায়—শিক্ষার্থী জার্মানিতে থাকাকালীন নিজ খরচে জীবনযাপন করতে পারবে। এই অর্থের জোগান দিতে গিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।
ভিসা প্রক্রিয়ার অস্পষ্টতা: ধৈর্য্যই এখন একমাত্র সম্বলজার্মান দূতাবাস তাদের ফেসবুক পেজে স্পষ্ট জানিয়েছে, বর্তমানে অতিরিক্ত আবেদন জমা পড়ায় নির্দিষ্ট কোনো ওয়েটিং টাইম জানানো সম্ভব নয়। তারা আবেদনকারীদের ধৈর্য ধরতে বলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কতটা ধৈর্য ধরলে এই অন্ধকার টানেলের শেষে আলো দেখা যাবে?
করোনার পরে ওয়েটিং টাইম ছিল ১২-১৫ মাস। এরপর তা বাড়তে বাড়তে এখন অজানার দিকে গড়াচ্ছে। বার্ষিক ভিসা প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতা যেখানে দুই হাজার সেখানে আবেদনকারীর সংখ্যা ৮০ হাজার—এই পরিসংখ্যান নিজেই একটি অশনি সংকেত।
সরকারি পদক্ষেপ কতটা কার্যকর?ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা জানান, তারা একাধিকবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। যদিও মন্ত্রণালয় আশ্বাস দিয়েছে জার্মান দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলার, কিন্তু দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন নেই। রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার অবশ্য বলেছেন, ভিএফএস-এর মাধ্যমে ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ার কিছুটা আউটসোর্সিং করা হয়েছে। এতে চাপ কিছুটা কমেছে। তবে সেটি যে কার্যকরভাবে শিক্ষার্থীদের সমস্যা দূর করতে পারছে না, সেটি বাস্তব চিত্রই বলে দিচ্ছে।
একটি সমাধানহীন ক্লান্তি, যা নিঃশেষ করছে প্রজন্মকেযারা জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় কাটাচ্ছে এই ‘ওয়েটিং পিরিয়ড’-এর ফাঁদে, তারা শুধু সময় হারাচ্ছে না, হারাচ্ছে মানসিক শান্তি, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, এমনকি আত্মবিশ্বাসও। একেকটি স্বপ্ন যেন প্রতিনিয়ত পুড়ে যাচ্ছে দাফতরিক জটিলতার আগুনে। কেউ কেউ বিকল্প দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, কেউ আবার ভেঙে পড়ছেন মানসিকভাবে।
এই সংকট শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করছে। যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে অবদান রাখতে চেয়েছিল, তাদের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে কাগজপত্র, ফি আর ভিসার সময়সীমায়।
জার্মানি যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হাজারো মেধাবী তরুণ-তরুণীর কাছে এখন ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ শব্দটি যেন একটা দুঃস্বপ্ন। এই দীর্ঘ অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ—উদ্যোগ ও সমন্বয়। সরকার, দূতাবাস এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসাথে বসে একটি সমাধান খুঁজে বের করতেই হবে। স্বপ্নের মুদ্রা যেন অপেক্ষার ভারে চূর্ণ না হয়ে যায়—এই আহ্বানই আজ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
এমআরএম/জিকেএস