জাতীয়

‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি থেকে কী জানান দেওয়া হলো?

‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি থেকে কী জানান দেওয়া হলো?

উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম চারদিক থেকে লাখো মানুষের জমায়েত ঘটেছিল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। শনিবার ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে জোরালো প্রতিবাদ ছিল গাজার গণহত্যা বন্ধ করা। দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ শামিল হন এতে।

Advertisement

দিনব্যাপী ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম এ কর্মসূচির আয়োজন করে। বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ছিল সড়কে অবস্থান কর্মসূচি। এরপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। পাশাপাশি চারটি স্তরে আলাদা দাবি ও অঙ্গীকার তুলে ধরা হয়। ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।

কর্মসূচিতে অংশ নিতে ট্রেনে, বাসে চড়ে দূর-দূরান্ত থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসেন লাখ লাখ মানুষ। ফিলিস্তিনের পতাকা ও গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে নানা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যায় অনেককে। হাতে থাকা প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুনে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধ, ইসরায়েলি পণ্য বয়কট, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে বয়কটেরও আহ্বান জানান অনেকে।

‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম এ কর্মসূচির মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, হেফাজতে ইসলামের নেতাসহ কয়েকজন ইসলামী বক্তা এবং জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব।

Advertisement

লোকে লোকারণ্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

শনিবার (১২ এপ্রিল) বিকেল ৩টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ গণজমায়াতের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষের ঢল নামে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সকাল থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই জড়ো হতে থাকেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। দুপুর হতে না হতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মাঠ ছাপিয়ে মৎস্যভবন, শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়।

কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া অনেকে বলেন, ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধের দাবি এবং মুসলিম বিশ্বকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাতেই এতে অংশ নিয়েছেন তারা। বিশ্ববাসীকে এক হওয়ার আহ্বানও জানান তারা।

মুসলিম বিশ্বকে সোচ্চার হওয়ার দাবি

কর্মসূচিতে অংশ নিতে যারা এসেছিলেন তাদের অনেকের হাতে ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা। ইসরায়েলবিরোধী স্লোগান দেওয়া ও প্রতিবাদী নানা ধরনের ফেস্টুন বহন করতেও দেখা যায় তাদের। এই প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে বিরোধী শক্তিকে জানান দিতে চান তারা, মুসলিমদের আলাদা করা যাবে না। ফ্রি ফ্রি প্যালেস্টাইন স্লোগানে মুখরিত হয় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

আরও পড়ুন:

Advertisement

মার্চ ফর গাজা: মিছিলের নগরী ঢাকা  মার্চ ফর গাজায় অংশ নিলো যেসব রাজনৈতিক দল  যা আছে ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারনামায়  ঘোষণাপত্রে দাবি ও অঙ্গীকার

এই পদযাত্রা ও গণজমায়েত থেকে চারটি স্তরে আমাদের দাবিসমূহ উপস্থাপন করা হয়। প্রথম দাবিগুলো জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি। যেহেতু জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব জাতির অধিকার রক্ষার, দখলদারত্ব ও গণহত্যা রোধের সংকল্প প্রকাশ করে।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি জোরালো দাবিসমূহ

জায়নবাদী ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধবিরতি নয়-গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে। পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে হবে।

মুসলিম উম্মাহর নেতাদের প্রতি দাবি

ফিলিস্তিন কেবল একটি ভূখণ্ড নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর আত্মপরিচয়ের অংশ। গাজা এখন কেবল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার বেদনাদায়ক প্রতিচ্ছবি। উম্মাহর প্রতিটি সদস্য, প্রতিটি রাষ্ট্র এবং প্রতিটি নেতৃত্বের ওপর অর্পিত সেই আমানত, যা আল্লাহ প্রদত্ত ভ্রাতৃত্ব ও দায়িত্বের সূত্রে আবদ্ধ। ইসরায়েল একটি অবৈধ, দখলদার, গণহত্যাকারী রাষ্ট্র, যা মুসলিমদের প্রথম কিবলা ও একটি পুরো জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদ আজ এই অঞ্চলে জায়নবাদী প্রকল্পের প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত দমন-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতে সম্প্রতি ওয়াকফ সম্পত্তি আইনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মুসলিমদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক অধিকার হরণ করা হয়েছে, যা উম্মাহর জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা।

মুসলিম বিশ্বের সরকার ও ওআইসির মতো মুসলিম উম্মাহর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর কাছে আহ্বান জানানো হয়।

ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক অবিলম্বে ছিন্ন করতে হবে। জায়নবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। গাজার মজলুম জনগণের পাশে চিকিৎসা, খাদ্য, আবাসন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরায়েলকে এক ঘরে করতে সক্রিয় কূটনৈতিক অভিযান শুরু করতে হবে। জায়নবাদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসনের অধীনে মুসলিমদের অধিকার হরণ, বিশেষ করে ওয়াকফ আইনে হস্তক্ষেপের মতো রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দৃঢ় প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থান নিতে হবে।

বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি

বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র, যার স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তিতেই নিহিত রয়েছে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেতনা। ফিলিস্তিনের প্রশ্নে বাংলাদেশ কেবল মানবতার নয় ঈমানের পক্ষেও এক ঐতিহাসিক অবস্থানে আছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সরকারের দায়িত্ব, জনগণের ঈমানী ও নৈতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা। বাংলাদেশের জনগণ গাজার পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে। তাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীরবতা এই জনআকাঙ্ক্ষার প্রতি অবজ্ঞার শামিল।

আরও পড়ুন:

নির্যাতিত শিশুদের প্রতীকী রক্তাক্ত কফিন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে  নারীরাও অংশ নিয়েছেন মার্চ ফর গাজা কর্মসূচিতে  বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আহ্বান

বাংলাদেশি পাসপোর্টে ‘Except Israel’ শর্ত পুনর্বহাল করতে হবে এবং ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার অবস্থান আরও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে। সরকারের ইসরায়েলি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যত চুক্তি হয়েছে তা বাতিল করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে গাজায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং আমদানি নীতিতে জায়নবাদী কোম্পানির পণ্য বর্জনের নির্দেশনা দিতে হবে। জায়নবাদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের অধীনে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে। যেহেতু হিন্দুত্ববাদ আজ শুধু একটি স্থানীয় মতবাদ নয় বরং আন্তর্জাতিক জায়নিস্ট ব্লকের অন্যতম দোসর। পাঠ্যবই ও শিক্ষা নীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন এবং মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ মুসলিম প্রজন্ম নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয় নিয়ে গড়ে ওঠে।

অঙ্গীকারসমূহ

সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বয়কট করবো প্রত্যেক পণ্য, কোম্পানি ও শক্তিকে যারা ইসরায়েলের দখলদারত্বকে টিকিয়ে রাখে। আমরা আমাদের সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রস্তুত করবো যারা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সব প্রতীক ও নিদর্শনকে সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করবে, ইনশাআল্লাহ। আমরা আমাদের সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলবো যারা নিজেদের আদর্শ ও ভূখণ্ড রক্ষায় জান ও মালের সর্বোচ্চ ত্যাগে প্রস্তুত থাকবে। আমরা বিভাজিত হবো না কারণ আমরা জানি, বিভক্ত জনগণকে দখল করতে দেরি হয় না।আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকবো, যাতে এই বাংলাদেশ কখনো কোনো হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের পরবর্তী গাজায় পরিণত না হয়। আমরা শুরু করবো নিজেদের ঘর থেকে ভাষা, ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সমাজ সবখানে এই অঙ্গীকারের ছাপ রেখে।

সবশেষ মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয় মার্চ ফর গাজা কর্মসূচি। মোনাজাত করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেক।

এসএনআর/এমএস