মতামত

রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা

আড্ডায় কত কথাই হয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, হালকা কৌতুক। কিন্তু ঘুরে ফিরে রাজনীতিই বেশি আলোচিত হয়। একজন তুললেন সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কথা। বললেন, তার ইউনিয়নে ভোটের পরও আওয়ামী লীগের প্রার্থী আর আর বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদ লেগেই আছে। গণমাধ্যমে এমন খবর প্রায় সব খান থেকেই আসছে। এবারের মতো সহিংস ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন মানুষের স্মৃতিতে আছে কিনা সন্দেহ। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের প্রথম চার ধাপে নির্বাচনী সহিংসতায় ১০১ জন নিহত হয়েছে, যা প্রাণহানির অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এমনটাই দাবি করেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। গত বৃহস্পতিবার সুজনের কর্মকর্তারা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাংলাদেশে অতীতের যেকোনো ইউপি নির্বাচনের চেয়ে এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে। দেশের সর্ব নিম্নস্তরের নির্বাচনে ব্যাপক অনিময় ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। ইউপি নির্বাচন এখন দুঃস্বপ্নের নির্বাচন। এই নির্বাচনে মৃত ব্যক্তিরাও ভোট দিয়েছেন! যা স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থার ১৫০ বছরের ইতিহাসের সব চেয়ে ভয়াবহ।  সব ধাপ শেষে জানা যাবে কতজন মারা গেলো। কিন্তু কেন্দ্রের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে যারা দল পরিচালনা করেন তারা ভাবতেও পারবেন কি স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি হলো দলের তৃণমুল পর্যায়ে। ভোট শেষ হবে। কিন্তু হিংসা, বিদ্বেষ আর ক্ষোভ থেকে যাবে। জয়পরাজয়ের ফয়সালা হয়েছে, হয়তো হবেও। কিন্তু অন্তরের আগুন নেভাবে কে? যারা স্বজন হারিয়েছে, যিনি তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মীর লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন, যাদের বাড়িঘর জ্বালানো হয়েছে, যিনি যোগ্যতায় এগিয়ে থেকে মনোনয়ন বাণিজ্যের কাছে হেরে দলের প্রতীক পাননি তারা ভুলবেন না। সুযোগ পেলেই প্রতিশোধ নেবেন।   বাংলাদেশের রাজনীতির লড়াইয়ের এক নতুন রূপ দেখছি আমরা। বিভিন্ন প্রান্ত হতে সন্ত্রাসের সংবাদ আসছে। নির্বাচন শেষ হয়েছে, কিন্তু এখনও আগুন জ্বলে, জনপদ রক্তাক্ত হয়। সহিংসতাই রাজনীতির অভিজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে।এবারই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রথম দলীয় প্রতীক দেয়া হলো শুধু চেয়ারম্যান প্রার্থীর জন্য। দলের প্রতীক এমনই শক্তিশালী যে নির্বাচনের আগেই বহু সংখ্যক সরকারদলীয় প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু শুধু  চেয়ারম্যান পদে এই প্রতীক দেয়ায় ক্ষমতাসীন দলে বিপজ্জনক মাত্রায় কোন্দল বেড়েছে, মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে ভয়ংকর ভাবে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অতীতে যারা বিজয়ী হতেন তাদের দলীয় পরিচয় থাকলেও সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ছিল। ব্যক্তি ইমেজ, পারিবারিক প্রভাব, আঞ্চলিকতা ভোটযুদ্ধে ফ্যাক্টর হতো। যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন তারও একই ধরনের যোগ্যতা ও শক্তি থাকত। এতে ভোট হতো উৎসবমুখর ও গ্রহণযোগ্য। বিশাল ভোটযজ্ঞে ছোটখাটো হাঙ্গামা ঘটলেও এবারের মতো অসহিষ্ণু, জঙ্গি রাজনৈতিক সহিংসতা ও ক্ষমতাসীন দলের উন্নাসিকতার চিত্র অতীতে কখনো দেখা যায়নি। কিন্তু প্রশ্ন হলো শাসক দল আওয়ামী লীগ কি অর্জন করেছে সহিংসতা আর অনিয়মে পূর্ণ এই নির্বাচন থেকে? যে নির্বাচন এক ধাপে করা যায় সেই নির্বাচন করতে হলো ছয় ধাপে। দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করতে গিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রভাশালী নেতাদের চাপে আইনশৃঙ্খলার রাশ সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কোথাও সামান্যতম কঠোরতা দেখা যায়নি যদিও প্রায় প্রতিটি কলহে নিজেদের কর্মীই খুন হয়েছে। দলীয় রং বিচার করতে গিয়ে আইন ভঙ্গকারী, সন্ত্রাসীদের হাতেই আইন তুলে দেয়া হয়েছে। নিরপেক্ষ প্রশাসন রাজধর্মের প্রথম শর্ত। নিরপেক্ষতার বিন্দুমাত্র প্রদর্শন কোথাও দেখা যায়নি প্রশাসন থেকে। শাসক দলের বিরুদ্ধে বিরোধীদের আন্দোলন আমরা দেখেছি। সে আন্দোলনে হিংসা ছিল, ছিল মানুষকে পুড়িয়ে মারার মতো ভয়ংকর সংস্কৃতির আমদানি। দীর্ঘ সাধারণ রাজনৈতিক আন্দোলন দেখে অভ্যস্ত বাংলাদেশ দেখলো জামায়াত-শিবির আর বিএনপি’র যৌথ জঙ্গি আন্দোলন। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত কোথাও এর কমতি ছিল না। এবার দেখা গেলো নির্বাচনে খুনের উৎসব।জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সঙ্কীর্ণ দলীয় আধিপত্য সমাজকে অবৈধ ভাবে নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তারের যে প্রক্রিয়া আমরা দেখছি তা ভয়ংকর। প্রতিপক্ষ এখন শুধু বিরোধী দল নয়, নিজদলের লোকও। আধিপত্যকামিতার সংস্কৃতির পাশাপাশি পরিলক্ষিত হয়েছে সেই আধিপত্যর বিরুদ্ধে হিংসাশ্রয়ী লড়াই। অর্থাৎ দলের বাইরে শুধু নয়, প্রতীকের বাইরে থাকলেই তাকে খতম করা সহি, এমন মানসিকতার প্রশ্রয়। রাজনৈতিক উন্মত্ততার এমন প্রকাশকেই বলে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা। এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতার প্রায় শতভাগ শাসক দলের বাহুবলীদের দ্বারাই হয়েছে। তাদের সংযত করার কোনো দলীয় উদ্যোগ চোখে পড়েনি। মুখে কুলুপ এঁটে নেতারা রাজধানীতে বসে টেলিভিশন পর্দায় ক্রিকেট ম্যাচ দেখার মতো করে দেখেছেন মৃত্যুর স্কোর কোথায় কত হয়েছে। শান্তি ফিরিয়ে আনার কাজটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। চেষ্টা করা ভিন্ন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কোনো গত্যন্তর নাই। কিন্তু তারা করবেন কী?আওয়ামী লীগের উপলব্ধির সময় এসেছে। দলে ভেতরে এই নির্বাচন কতোটা রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে, তৃণমূলের ঘরে এই নির্বাচন কতটা বিবাদ স্থায়ী রূপ দিয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় এসেছে। এই রক্তক্ষয়ী ইউপি নির্বাচনের কী দরকার ছিল? বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন করলে সরকার ও নির্বাচন কমিশন অন্তত: প্রাণহানিতো এড়াতে পারতেন।  লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভিএইচআর/পিআর

Advertisement