কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় হিসনা নদীর সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বদ্ধপরিকর স্থানীয় জনগণ ও যুব সমাজ। তারা ‘হিসনা নদী সুরক্ষা’ ব্যানারে সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। হিসনা নদীকে দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে এই প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেন স্থানীয়রা।
Advertisement
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে সেতুর নিচে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও পথচারী ময়লা ফেলেন। এতে সেতুর নিচে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়। দুর্গন্ধে মানুষের চলাফেরায় অসুবিধা হয়। অসচেতনভাবে ফেলা আবর্জনার স্তূপ তৈরি হয়। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত এবং পরিবেশ দূষিত হয়। বর্ষাকালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। এ সমস্যা সমাধানে স্থানীয় জনগণ ও যুব সমাজ একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
হিসনা নদী সুরক্ষার কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম সেতুতে রং করা, সেতুর আশেপাশে এবং নদীর পাড়ে সচেতনতামূলক ব্যানার ও ফেস্টুন লাগানো। এসব ব্যানার ও ফেস্টুনে ‘এখানে ময়লা ফেলবেন না’, ‘নদী আমাদের জাতীয় সম্পদ’, ‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ গড়ুন’ ইত্যাদি বার্তা লেখা আছে। এ ছাড়া স্থানীয় যুব সমাজ নিয়মিতভাবে এলাকাটি পরিদর্শন করছেন। যারা ময়লা ফেলতে উদ্যত হচ্ছেন; তাদের সচেতন করছেন।
এ কার্যক্রমের একজন উদ্যোক্তা মো. হোসেন শহীদ বলেন, ‘যখন প্রথম দেখি ব্রিজের নিচে এত নোংরা; তখন খুব খারাপ লেগেছিল। মনে হয়েছিল, নিজেদের জায়গাটা আমরাই নষ্ট করছি। সেই ভাবনা থেকে কয়েকজন ছোট ভাই ও বন্ধু মিলে এ উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবি। আমরা চাই, আমাদের নদী ও ব্রীজের নিচে পরিষ্কার থাকুক। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন একটি সুন্দর পরিবেশে বড় হতে পারে। শুধু ব্যানার লাগিয়েই আমরা থেমে থাকবো না।’
Advertisement
তিনি বলেন, ‘আমরা স্থানীয়দের ও যুব সমাজ নিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করতে চাই। যারা নিয়মিত এলাকার পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশ নেবেন। আমরা বিশ্বাস করি, সম্মিলিত প্রচেষ্টাই একটি স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো। অনেকেই না জেনে বা অসচেতনভাবে এখানে ময়লা ফেলেন। তাদের বোঝাতে চাই যে, এর ফলে পরিবেশের কতটা ক্ষতি হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের প্রচারপত্র বিলি করারও পরিকল্পনা করছি।’
স্থানীয় বাসিন্দারাও এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, এ ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে আগ্রহ জন্মাবে।
মো. মাহি উদ্দিন মুন্না বলেন, ‘আমরা দেখেছি, পর্যাপ্ত ডাস্টবিন না থাকায়ও মানুষ বাধ্য হয়ে যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলে। আমরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাবো, যেন এ এলাকায় কিছু ডাস্টবিন স্থাপন করা হয়। তাহলে হয়তো এ সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে। তরুণরা সব সময়ই পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত। এ উদ্যোগ আমাদের সেই চিন্তা-ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার একটি সুযোগ করে দিয়েছে। আশা করি, আমাদের দেখে অনেক তরুণ এ ধরনের কাজে উৎসাহিত হবেন।’
আরও পড়ুনপরিযায়ী পাখিদের রক্ষায় করণীয়এক ফোঁটা পানি, এক ফোঁটা জীবনরিজভী আহমেদ তুষার বলেন, ‘হিসনা নদী আমাদের অঞ্চলের প্রাণ। একে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা নৈতিক দায়িত্ব। ব্রিজের নিচে যেভাবে আবর্জনা ফেলা হচ্ছিল, তা দেখে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। তাই আমরা এ পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করেছি। আশা করি, এ প্রচেষ্টা স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে। সবাই মিলেমিশে নদীটিকে রক্ষা করবে। ব্রিজের নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় না, দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। ব্যানার লাগানোর পর থেকে কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তবে সবারই দায়িত্ব স্থানটিকে পরিষ্কার রাখা এবং অন্যদেরও সচেতন করা।’
Advertisement
মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে যখন ব্রিজের নিচে করুণ দশা দেখলাম; তখন আর চুপ করে থাকতে পারিনি। ছোটবেলার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই নদীর সাথে। আজ সেই নদী আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। মূল উদ্দেশ্যই হলো স্থানীয়দের মধ্যে ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ জাগানো। আমরা চাই, প্রত্যেক মানুষ এ নদীকে নিজের মনে করুক। এর পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় এগিয়ে আসুক।’
তবে এ উদ্যোগের সফলতা শুধু সচেতনতার ওপর নির্ভরশীল নয়। স্থানীয় প্রশাসন ও পৌর কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নজরদারি এবং ময়লা ব্যবস্থাপনার সঠিক পরিকাঠামো তৈরি করাও জরুরি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। তারা আশা প্রকাশ করেন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাদের প্রিয় নদীকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা যাবে।
চা ব্যবসায়ী মো. কালাম হোসেন বলেন, ‘আমাদের ব্যবসার অনেকটাই নির্ভর করে এখানকার পরিবেশের ওপর। ব্রিজের নিচে যদি নোংরা থাকে, দুর্গন্ধ ছড়ায়, তাহলে কাস্টমার আসবে কেন? ফেস্টুনগুলো দেখে যদি মানুষ সচেতন হয় এবং নদী পরিষ্কার রাখে, তাহলে আমাদের ব্যবসা আরও ভালো হবে।’
মুদি দোকানী মো. সাহাবুল ইসলাম বলেন, ‘দেখুন, নদী ভালো থাকলে আমাদের ব্যবসাও ভালো থাকবে। নদীর জল যদি পরিষ্কার থাকে, মানুষজন আসবে, ঘুরবে, কিনবে। এই যে ফেস্টুনগুলো লাগিয়েছে, এতে যদি মানুষের একটু বুদ্ধি খোলে, নদীর যত্ন নেয়, তাহলে আখেরে আমাদের সকলেরই লাভ।’
এ ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত নাগরিক উদ্যোগ নিঃসন্দেহে পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আশা করা যায়, অন্য এলাকার মানুষও এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তাদের পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসবেন।
এসইউ/জেআইএম