প্রতি বছর জুন মাসে সংসদে বাজেট উপস্থাপনের পর সেই বাজেটকে সময়োপযোগী বলে উল্লেখ করা হয় কিংবা বিএনপি’র মতো বিরোধী দলের পক্ষ থেকে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা বাজেটকে অভিনন্দন জানিয়ে রাস্তা মাথায় করে নাচে আর সেখান থেকে বলা হয় দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই এ বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে, এ বাজেট গণমুখি। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত বাজেটের বিরোধিতা করে হরতাল-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে। আর উপস্থাপিত বাজেট নিয়ে গণমাধ্যমে চলে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ। বাজেটের পর কিছু জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি পায় আর কিছু জিনিসের দাম কমবে বলা হলেও আদৌ কমে কিনা সন্দেহ থেকে যায়। বাজেট কেন্দ্রিক এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে গ্রামের গৃহস্থ ও শ্রমজীবী আর শহরের মধ্যবিত্ত ও নিন্মবর্গের জীবন বয়ে চলে।সাধারণ মানুষের কাছে দেশের উৎপাদন, ঘাটতি, আয়-ব্যয় প্রভৃতি ব্যাপারগুলো খুব একটা স্পষ্ট নয়। উপরন্তু তাদের কাছে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বাজেট প্রণয়ন করা হয় কিনা তাও পরিষ্কার নয়। সরকারের ঘোষিত অঙ্গীকার বাস্তবায়নে শতভাগ সফলতা অর্জিত হওয়ার ক্ষেত্রে বাজেটের গুরুত্ব কী সে বিষয়েও তারা ততটা সচেতন নয়। সব মিলিয়ে বলা চলে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও কল্যাণকামী দেশ গড়ার পথে বাজেট নিয়ে সরকারের ভাবনা-চিন্তার অংশীদারি তারা নয়। মানুষের সার্বিক কল্যাণকে মাথায় রেখে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে কিনা সে ভাবনা না থাকলেও সাধারণ মানুষের গার্হস্থ্য জীবনে বাজেটের অনিবার্য প্রভাব রয়েছে। অনেক সময় বাজেট ধনীকে আরো ধনী এবং গরিবকে আরো গরিব করে তুলতে পারে, দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে কিংবা ধনবৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্য অথবা সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। আবার বাজেট দেশের অর্থনীতিতে বিদেশের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি করে জাতির অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা ও নাজুকতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। তবে দেশের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যদি দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন থাকে তাহলেই সরকার বাজেট বাস্তবায়নে সফল হবে বলে আমাদের অভিমত।পূর্বেই বলা হয়েছে গার্হস্থ্য জীবনে বাজেটের গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রাম কিংবা শহরবাসী মধ্যবিত্ত চিন্তা করে- এবারের বাজেটে আয়করে ছাড় বাড়বে কিনা? রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের মূল্য বাড়ছে কিনা? পরিষেবা করের আওতায় যেন নতুন করে আর কোনো পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত না করা হয়; মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এখনই ব্যবস্থা নিক সরকার; বাজেট উপস্থাপনের আগে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা থাকে কোনো বাড়তি বোঝা না চাপিয়ে বাজেট হবে গণমুখি ইত্যাদি। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকের মনে আয়কর ছাড় সংক্রান্ত ঘোষণা নিয়ে আগ্রহ থাকে। কেউ কেউ মনে করেন বর্তমানে যেখানে বার্ষিক তিন`লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করলে কর দিতে হয় না, সেখানে আগামী বাজেটে আয়ের সীমা বাড়িয়ে পাঁচ লক্ষ টাকা করা উচিত। তাহলে এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে সাধারণ চাকুরিজীবীদের একটু স্বস্তি আসে। কিন্তু শুধু আয়করে ছাড় নয় যে মধ্যবিত্ত নিজের জমানো টাকা দিয়ে কষ্ট করে একটি গাড়ি কিনেছেন তিনি চাইবেন সিএনজি, অকটেন, পেট্রোল, ডিজেলের দাম যেন কম থাকে। আর বছরে ভর্তুকি এমন পরিমাণ থাকা দরকার তা যেন বিদ্যুতের মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সব মানুষের তো ইনডাকশন কুকার বা মাইক্রোওভেন কেনার ক্ষমতা নেই। তবু বিদ্যুতের বিল বেশি এলে চাপটা মাসের কাঁচা বাজারের ওপর পড়ে। বাজেটে এসব সমস্যার সমাধান থাকা একান্ত প্রয়োজন। আসলে গার্হস্থ্য বাজেট ভাবনায় পরিষেবার জন্য কর বা ভ্যাটের জন্য ততটা নয় কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরব থাকেন সকলে। গত সাত বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাজার মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও বিদ্যুতের দাম একাধিকবার বৃদ্ধি করায় তার প্রভাবে ভোগ্যপণ্যের মূল্য কিছুটা ঊর্ধ্বমুখি ছিল। এজন্য বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকাটা জরুরি। তাছাড়া শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার যুব সমাজের চাকরি হওয়ার ব্যাপারে বাজেটে নির্দিষ্ট কোনো নীতির ঘোষণা থাকলে স্বপ্নময় হয়ে উঠবে আজকের প্রজন্ম। বাজেট মানেই কিছু পণ্যের উপর বাড়তি কর বৃদ্ধি। আর কিছু পণ্যে কর ছাড়। গার্হস্থ্য জীবনে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক জিনিসের কদর বেড়েছে। এজন্য অনেকেই প্রত্যাশা করেন দাম কমুক ল্যাপটপ, স্মার্টফোনের।একথা ঠিক সাধারণ মানুষ জিডিপির পরিমাণই জানেন না- তার শতকরা তো দূরের কথা। প্রতিবছর বাজেটের ঘাটতি পূরণের নানা পরিকল্পনা ঘোষিত হয়। আর শেষ পর্যন্ত দেখা যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের বর্ধিত বোঝার ভার জনগণকেই বইতে হচ্ছে। পূর্ববর্তী বছরের বাজেটে করারোপের সীমারেখা বাড়ানো হয়েছিল। ফলে দু-চারটা জিনিস ছাড়া আজকাল প্রায় সবকিছুতেই ভ্যাট দিতে হয়, আর তা গরিব-ধনী সবার ব্যাপারেই সমানভাবে প্রযোজ্য। সাধারণ মানুষ হয়তো মনে করে, জিনিসের দাম এমনিতেই বেড়েছে কিন্তু তা যে প্রতিটি ক্ষেত্রে ভ্যাট যোগ করার জন্য তাও সবাই জানেন না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, অতি দরিদ্র মানুষও করের আওতামুক্ত নয়। মানুষকে আয়ে যেমন কর দিতে হয়, প্রায় প্রতিটি ব্যয়েও ভ্যাট দিতে হয়। অন্যদিকে বাজেট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে লম্বা লিস্ট প্রকাশ করা হয় কী কী জিনিসের দাম কমবে ও বাড়বে। কিন্তু মূল্য কমলে সেই পণ্যের দাম ভোক্তার ক্ষেত্রে খুব একটা প্রযোজ্য হতে দেখা যায় না। আবার সরকারের কোনো সংস্থা এসব কখনো নিশ্চিত করে জনগণকে ফায়দা পাইয়ে দিয়েছে- এমন কথা কেউ কখনো শুনেছেন বলেও মনে হয় না। এসবই সাধারণ ভোক্তার অভিজ্ঞতা এবং সব সরকারের আমলেই এই একই অভিজ্ঞতা পরিলক্ষিত হয় কিন্তু কেউ কখনো এর প্রতিকার করেন না।গার্হস্থ্য বাজেটের এ বাস্তবতায় নিজের জীবন-জীবিকা নিয়ে এভাবে মানুষকে সংগ্রাম করতে হয় নিরন্তর। সন্তানদের স্কুলে আনা-নেওয়ার পরিবহন ব্যয় দেশের সব বড় শহরের ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্ত ও নিন্মবর্গের জন্য একটি দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এ বৃত্তের মানুষ যখন দেখে তার আয় দিয়ে আগের চেয়ে কম দ্রব্য পাওয়া যায় তখন জীবনমান হ্রাস করে। সেই পরিস্থিতিতে সন্তানদের নিয়ে ভয়ঙ্কর ভিড় ঠেলে বাসে চড়তে হয়। স্কুলে আনা নেওয়ায় যে শ্রমঘণ্টা ব্যয় হয় তা দিয়ে সংসারের উন্নয়নে একটি কাজ করার সুযোগ হারান অনেক নারী। নতুন বাজেট এলেও সাধারণ ও নিম্নআয়ের মানুষের আয় আর প্রয়োজনমতো বাড়ে না। তাই টানাটানি আর কষ্ট ছাড়া উপায় থাকে না। উচ্চ আয়ের মানুষের আয় অনেক বাড়লে গড় আয় বাড়ে তবে সাধারণ মানুষের তাতে কিছু পরিবর্তন হয় না। আমাদের জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টন হলেই কেবল সেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। এজন্য আগামী ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের বাজেটে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা নিত্যপণ্যের দাম যেন বৃদ্ধি না পায়। এছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, পয়ঃনিষ্কাশনসহ জনদুভোর্গ থেকে মুক্তি চায় দেশের সাধারণ মানুষ।লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।এইচআর/এমএস
Advertisement