সাহিত্য

হৃদয়ের মণিকোঠায় চির জাগরূক সন্‌জীদা খাতুন

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর

Advertisement

জেলা শহর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে যখন ভার্সিটিতে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা এলাম; তখন ঠিকানা হলো ধানমন্ডি। আমার ক্যাম্পাস ছিল সাত মসজিদ রোড আর বাসা মিরপুর। প্রথম প্রথম ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে শংকর বাসস্ট্যান্ডের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাড়ি বেশ ভালো লেগেছিল। গাছগাছালিতে ঘেরা বড়সড় লাল ইটের ভবন। লেগুনার ভেতর থেকে প্রথম দেখায় মনে হতো বসতবাড়ি। এরপর যখন একটু একটু করে এই শহরের সাথে পরিচয় ঘটতে লাগলো; তখন বেশ কয়েকবার এই ভবনের পাশ দিয়ে হেটেও গিয়েছি! দেখেছি সারাদিন এই ভবনে শিশু থেকে শুরু করে নানা স্তরের সংস্কৃতিপ্রেমীর পদচারণ। মাঝেমধ্যে পড়ন্ত বিকেলে এখান থেকে ভেসে আসে মধুর ধ্বনি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। পরে অবশ্য জেনেছি, এই ভবন আসলে সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য তীর্থস্থানতুল্য। এটিই বিখ্যাত সেই ছায়ানট।

প্রতিষ্ঠানটির কথা উঠলে শুরুতে যাঁদের নাম গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, অধ্যাপক ড. সন্‌জীদা খাতুন তাঁদের অন্যতম। বাংলাদেশের এক অহংকারের নাম সন্‌জীদা খাতুন। বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালিত্বের বোধকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার, আপন সংস্কৃতির শক্তিতে বিকশিত করার প্রেরণা জুগিয়ে চলছেন সারাজীবন ধরে মানুষটি। দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পথপ্রদর্শকও তিনি। আমাদের সমাজে গায়ক বা শিক্ষক হিসেবে অনেকেই স্মরণীয়; কিন্তু আজীবন সুরের শিক্ষাদান করেছেন, সাংস্কৃতিক নানা কর্মযজ্ঞের কাণ্ডারি হয়ে রয়েছেন অথচ সংগীতকে পেশা হিসেবে নেননি; এমন দৃষ্টান্ত বিশেষ নেই। সেদিক থেকে বলতেই হয়, সংগীত সন্‌জীদা খাতুনের জীবিকা নয়, সংগীত তাঁর যাপিত জীবনের অবলম্বন; আন্দোলন-সংগ্রামের হাতিয়ার।

রবীন্দ্রসংগীতের পথপ্রদর্শক, সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার আলোকবর্তিকা, ছায়ানটের প্রাণপুরুষ, রমনার বটমূলে বৈশাখ বরণের উদ্যোক্তা এবং শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যতম সংরক্ষক—এ সবকিছুতেও যেন এক মহীয়সী সন্‌জীদা খাতুনের পরিপূর্ণ পরিচিতি আসে না। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আকাশে তিনি এক নক্ষত্র, যার আলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বোপরি সন্‌জীদা খাতুন যে একজন আটপৌরে বাঙালি, আমাদের জন্য এটি অনেক বড় পাওয়া। বর্ণাঢ্য জীবন তাঁর। তরুণ বয়স থেকেই যুক্ত হয়েছেন আন্দোলন-সংগ্রামে। কিন্তু সব সংগ্রামের অবসান ঘটিয়ে তিনি যাত্রা করেছেন অনন্তের পথে। তবে এ শুধু যাওয়া নয় বরং থেকে যাওয়া—হৃদয়ের মণিকোঠায় চির জাগরূক হয়ে থাকা।

Advertisement

ছায়ানটের প্রতিষ্ঠা ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব

সন্‌জীদা খাতুনের সাংগঠনিক দক্ষতা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় ছায়ানট প্রতিষ্ঠায়। ১৯৬১ সালে সাংস্কৃতিক সংগঠনটি যখন আত্মপ্রকাশ করে; তখন বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার পুনরুত্থান ছিল সময়ের দাবি। পাকিস্তানি শাসনামলের নিপীড়ন আর ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাতের বিরুদ্ধে ছায়ানট হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের প্রতীক। সন্‌জীদা খাতুনের নেতৃত্বে ছায়ানট কেবল সংগীতচর্চার কেন্দ্র নয় বরং এক প্রাণময় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারক হয়ে ওঠে। আমাদের জন্য ছায়ানট যেন একটি অব্যাহত সাংস্কৃতিক আন্দোলন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও মানবিক চর্চারও একটি কেন্দ্র। আমাদের সবাইকে, দেশের মানুষকে সঞ্জীবিত করে চলেছে ছায়ানট। সহজ করে বললে রমনার বটমূলে ছায়ানটের আসর ছাড়া এখন আমাদে নববর্ষই আসে না। বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মানবিক বাংলাদেশ গঠনের কাজে এই যে সংগঠনটি পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রাখছে, তার অন্যতম জাদুকর সন্‌জীদা খাতুন।

এই ছায়ানট নিয়ে ২০১৭ সালে একটি বড় স্টোরি করতে গিয়ে জেনেছি, ছায়ানট গঠনের পর আবদুল আহাদের পরিচালনায় পুরোনো গানের এক বড় সফল অনুষ্ঠান হয়েছিল। পরে শুরু হলো শ্রোতার আসর। প্রথম আসরে গান গেয়েছিলেন শিল্পী ফিরোজা বেগম। তাঁর পরের শিল্পী ছিলেন ফাহমিদা খাতুন। তারপরও কিছু অনুষ্ঠান হলো। একসময় প্রশ্ন দেখা দিলো, এত শিল্পী কোথায়? তখনই গানের স্কুল করার কথা হলো এবং ১৯৬৩ সালে শুরু হলো ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন। ওয়াহিদুল হক ছিলেন এর পেছনের মূল উদ্যোক্তা আর তার সঞ্জীবনী ছিলেন সন্‌জীদা খাতুন। এরপর ছায়ানট আর থেমে থাকেনি। দশকের পর দশক ধরে ছায়ানট নানা সময়ে শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু এড়িয়ে বা সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তার সাহসী পথচলা অব্যাহত রেখেছে।

রমনার বটমূলে নববর্ষ বরণ

এই যে বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে পথ চলতে চলতে ছায়ানটের থেমে না থাকা, তার আরও একটি বড় অংশ হলো রমনার বটমূলে নববর্ষ বরণ। বাঙালির চেতনায় পহেলা বৈশাখ যেন চিরন্তন নবজাগরণের উৎসব। ১৯৬৭ সালে সন্‌জীদা খাতুনের প্রয়াসেই রমনার বটমূলে ছায়ানটের বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠান শুরু হয়, তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সেদিন সারারাত জেগে ও আশপাশ থেকে কিছু ফুল, কিছু গাছের পাতা-ডালসহ কিছু বেলুন নিয়ে ১০০-১৫০ ছাত্র মিলে করা হয়েছিল ছায়ানটের প্রথম পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান। সামনে ছিল ব্যানার ‘এসো হে বৈশাখ/ এসো এসো’। সেদিনের দর্শক-শ্রোতা হাততালি দিয়ে আয়োজকদের অভিনন্দিত করেছিলেন। যদিও তখন এ সাংস্কৃতিক উদ্যোগ ছিল সাহসী এক প্রতিবাদ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক নিপীড়নের মুখে রমনার বটমূলের সেই সংগীতানুষ্ঠান বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঘোষণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেদিন। আজও সেই ঐতিহ্য বহন করে চলেছে ছায়ানট। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। ২০০১ সালে নববর্ষের প্রভাতের এ অনুষ্ঠানে বড় রকমের জঙ্গি হামলা হলেও ছায়ানট বা সন্‌জীদা খাতুন এ অনুষ্ঠান থেকে সরে আসেননি। বরং আরও ভালোবেসে এ অনুষ্ঠান করে চলেছেন। তার পেছনে অনুপ্রেরণার নাম সন্‌জীদা খাতুন।

রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার ও প্রসার

মহিয়সী সন্‌জীদা খাতুন যেমন বহু গুণে গুণান্বিত; তেমনই বহু কর্মে সমর্পিত। যদি বলা হয়, কোন ক্ষেত্রে তাঁর অবদান বেশি উজ্জ্বল? এতে নানাজন নানা কথা বলবেন। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি স্বকীয়তায় উজ্জ্বল, সৃজনশীলতায় মুখর। একাধারে তিনি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষক। জাতীয় ও সামাজিক জীবনে, আন্দোলনে-সংগ্রামে সুর শুধু তাঁর সঙ্গী নয়, পরম আশ্রয়ও। সুরের ভেতর দিয়ে, বাণীর ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাব ও আদর্শ প্রচার ও প্রসারে জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গানের মর্মমূলে প্রবেশ করে তা উপলব্ধি করার ক্ষমতা যাঁর ছিল, তিনি সন্‌জীদা খাতুন। রবীন্দ্রসংগীতকে কেবল শিল্পের স্তরে নয়, জীবনের দর্শনে পরিণত করেছিলেন। তার কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান যেন জীবনের কথা হয়ে উঠতো। তিনি বিশ্বাস করতেন, রবীন্দ্রসংগীত শুধু সুরের মূর্ছনায় সীমাবদ্ধ নয় বরং মানবিকতার দর্শন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবধর্ম প্রচারে সন্‌জীদা খাতুনের তুলনীয় এদেশে তেমন কেউই নেই। তাঁর যাপিত জীবনের অনুষঙ্গও ছিল রবীন্দ্রদর্শন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে দূরে সরিয়ে রাখলে চলবে না, আবার চোখ বুজে তাঁর গান গাইলেই তাঁকে বোঝা যাবে না। তাঁকে সঠিকভাবে জানতে ও বুঝতে হলে প্রতিনিয়ত চর্চা করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ যে মানবধর্মের কথা বলে গেছেন, তা প্রথমে নিজেদের আচার-আচরণে দেশজ হতে হবে।’

Advertisement

আরও পড়ুন

আকিমুন রহমানের সাহিত্য: প্রেক্ষিত সমাজ-বাস্তবতা অভিভাবকহীন জীবনানন্দ দাশ সংগ্রহশালা শাস্ত্রীয় সংগীতের পৃষ্ঠপোষক

শুধু কি রবীন্দ্রসংগীত? শাস্ত্রীয় সংগীতের মতো ঐতিহ্যবাহী ধারা সংরক্ষণেও তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চা মানেই আত্মার পরিশুদ্ধি। ছায়ানটে শাস্ত্রীয়সংগীতের আসর আয়োজনের মাধ্যমে তিনি নতুন প্রজন্মকে এই উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট করেছেন। তার এই প্রচেষ্টা শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চাকে শক্তিশালী করেছে। তাঁর তত্ত্বাবধানে ছায়ানট এখন বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান, যা শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্যের প্রসারে কাজ করছে। তার তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় ওপার বাংলার অসংখ্য গুণি শিল্পী এসে শাস্ত্রীয় সংগীতে মুগ্ধ করেন ছায়নট এবং বাংলার শ্রোতাদের। তাই তো বলতে হয়, সন্‌জীদা খাতুন বাংলাদেশ বা বাঙালি সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সংরক্ষণের কাজ করেছেন—একক, একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে এবং তিনি কথায়, গানে, লেখায়, সংগঠনে, আয়োজনে ও আন্দোলনে আমাদের সামনে রয়েছেন সর্বক্ষণ।

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মার্চে রংপুর থেকে প্রথমে ঢাকায়, পরে সাভারের জিরাবো গ্রাম থেকে আবার ঢাকা হয়ে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতের আগরতলা রাজ্যে পৌঁছান সন্‌জীদা খাতুন ও তাঁর সাংস্কৃতিক সহযোদ্ধারা। সেখানে কিছুদিন থেকে ৫ মে কলকাতায় প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে প্রবাসে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ শুরু করেন তিনি। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নানা উদ্দীপক গানের সঙ্গে প্রচারিত হয় রবীন্দ্রনাথের গান। এর পেছনে মূল কারিগর ছিলেন সন্‌জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক। তাঁদের সক্রিয় উদ্যোগে গড়ে ওঠে গানের দল। তাঁরা ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ জুগিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো স্মরণ করে সন্‌জীদা খাতুন একবার বলেছিলেন, ‘আমাদের পালিয়ে যেতে হয়েছিল কলকাতায়। সেখানে গিয়ে আমরা ‘রূপান্তরের গান’ সংগঠন করি। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে, শরণার্থীদের শিবিরে এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য এই গান গাইতাম। কাজেই রবীন্দ্রসংগীত আমাদের আন্দোলনের মস্ত বড় একটি হাতিয়ার ছিল এবং এখনো আছে। এখনো আমরা বলি, রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’

সাহিত্যে অবদান

সন্‌জীদা খাতুন যে শুধু সংগীত বা সংগঠক হিসেবেই তার পরিচয় রেখেছেন তা নয়, বাংলা সাহিত্যেও তাঁর ভূমিকা অসামান্য। সন্‌জীদা খাতুন এই দেশজ চর্চার জন্যই শিল্প-সাহিত্যের নানা মাধ্যমে কাজ করেছেন, বাঙালির স্বরূপ সন্ধানের জন্যই লিখেছেন গবেষণাধর্মী নানা বই। মননশীল লেখক হিসেবে তাঁর অবদান অতুলনীয়। ভাষা, সাহিত্য ও সংগীত বিষয়ক গবেষণা ও মৌলিক রচনায় তাঁর সাফল্য ঈর্ষণীয়। রবীন্দ্রসংগীতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তাঁর গায়কসত্তা ও অধ্যাপকসত্তার অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে তাঁর রচনায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগীত ও চিন্তা ছাড়াও রবীন্দ্রসাহিত্যের ব্যাখ্যা ও পর্যবেক্ষণের বিস্তার ও গভীরতার ভিত্তিতে তাঁর নাম উচ্চারিত হয় আবু সয়ীদ আইয়ুব কিংবা শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে শ্রদ্ধাভরে। সুর-সংগীত বোধ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য বিশ্লেষণে সন্‌জীদা খাতুন প্রবর্তন করেছেন অন্যতর মাত্রা। তাঁর ‘কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’, ‘রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ’, ‘ধ্বনি থেকে কবিতা’, ‘অতীত দিনের স্মৃতি’, ‘তোমারি ঝর্ণাতলার নির্জনে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান’, ‘কাজী মোতাহার হোসেন’, ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’, ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতির চড়াই-উৎরাই’, ‘ধ্বনির কথা আবৃত্তির কথা’, ‘সংস্কৃতির বৃক্ষছায়ায়’, ‘সংস্কৃতি কথা সাহিত্য কথা’ ইত্যাদি গ্রন্থে তাঁর বহু বিস্তৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। মননশীল ও সৃজনশীল নানা রচনায় আমরা তাঁর যে উপলব্ধির সাক্ষাৎ পাই, সন্‌জীদা খাতুন তা অর্জন করেছেন তাঁর সাহিত্যসাধনা ও উচ্চতর গবেষণার মধ্য দিয়ে। বাংলা কাব্যগীতি বিশ্লেষণ ও রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ উন্মোচনে বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ ডিগ্রি ও ডক্টরেট সম্মাননাও অর্জন করেছেন তিনি।

অন্তিম যাত্রা

বাঙালির আত্মানুসন্ধান ও বাঙালির সংস্কৃতির জন্য অব্যাহত সংগ্রামে সন্‌জীদা খাতুনকে জীবনের প্রায় শুরু থেকে দেখা গেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায়। যখন তিনি কলেজের শিক্ষার্থী; তখন থেকেই পড়াশোনা, আবৃত্তি ও অভিনয়ের পাশাপাশি গানের চর্চা করেছেন। পাশাপাশি কিছু সাংগঠনিক কাজেও যুক্ত হয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘একুশ আমাকে ভাষা দিয়েছে।’ সেই ভাষার জন্য জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কাজ করেছেন তিনি। জীবনের শেষ অধ্যায়েও তিনি সংস্কৃতির প্রতি তাঁর দায়িত্ব ভুলে যাননি। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিয়মিত উপস্থিতি ছিল তাঁর অভ্যাস। ২৫ মার্চ তিনি চির বিদায় নিলেও তাঁর অবদান চিরকাল বাঙালির হৃদয়ে জাগরূক থাকবে। শেষবার যখন তার মরদেহ ছায়ানটে নেওয়া হলো; তখন শিক্ষার্থীরা গাইলেন—‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। তাঁর স্বপ্নের মতো করে এই শিক্ষার্থীরাই একদিন আলো হয়ে ফুটবে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান।’ সন্‌জীদা খাতুনও যেন সেই শ্যামসমান আলো হয়ে আমাদের হৃদয়ে থেকে গেলেন। শুধু যাওয়া নয়, তিনি থেকে গেছেন—চির ভাস্বর, চির উজ্জ্বল। তাঁর কর্ম ও আদর্শ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পথ দেখাবে, আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার প্রদীপ হয়ে জ্বলবে অনন্তকাল।

শেষ বাতিঘরের প্রস্থান

আমরা জানি, শুরুর দিন থেকেই ছায়ানটের একেবারে সামনের সারির মানুষ ছিলেন সন্‌জীদা খাতুন। শেষ ক্ষণটিও তার এ প্রাঙ্গণেই কাটলো। তিনি তো ছায়ানটকে পুরোটাই পেলেন, কিন্তু ছায়ানট? শংকরের গাছগাছালিতে ঘেরা সেই বড়সড় লাল ইটের ভবনটা এবার সত্যিই তার অভিভাবককে মিস করবে। অভিভাবকত্ব শূন্যতায় ভুগবো আমরাও। আলোর দিশারি আর কেউ রইলেন না আমাদের আলোকিত করার জন্য। ড. আনিসুজ্জামান, মুর্তজা বশীর, কামাল লোহানী, জামিলুর রেজা চৌধুরী, আবুল হাসনাত বা সন্‌জীদা খাতুন; তাঁরা একেকজন ছিলেন বাংলার জ্ঞান ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বিজ্ঞজন। তারা ছিলেন বাতিঘর। গত পাঁচ বছরে তাদের মৃত্যুর পর সন্‌জীদা খাতুনের মৃত্যু যেন বাংলার শেষ বাতিঘরের প্রস্থান।

চির স্মরণীয় আলোকবর্তিকা ছায়ানট প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সন্‌জীদা খাতুন বাঙালির চেতনায় নতুন প্রাণসঞ্চার করেছেন। বৈশাখ বরণকে কেন্দ্র করে রমনার বটমূলে বাঙালি সংস্কৃতির যে মহা মিলনমেলা গড়ে উঠেছে, তার নেপথ্যে সন্‌জীদা খাতুনের নিরলস প্রচেষ্টা ছিল। তিনি রবীন্দ্রসংগীতকে জনপ্রিয় করে তুলতে চর্চা এবং শিক্ষার সমন্বয়ে এক অনন্য পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর কণ্ঠের বীন্দ্রসংগীতের সুর যেন নতুন ব্যাখ্যা খুঁজে পেত। তাঁর স্মৃতি আমাদের প্রেরণা হয়ে থাকবে। বাংলার সংস্কৃতি ও চেতনায় তিনি চির স্মরণীয় হয়ে রয়ে যাবেন। তিনি হয়তো আমাদের ছেড়ে যাবেন, কিন্তু যাবেনও না। তার যাওয়া শুধু যাওয়া নয় বরং আমাদের হয়ে থেকে যাওয়া। আর তাঁকে হৃদয়ের মণিকোঠায় চির জাগরূক করে রেখে দেওয়া এখন আমাদের দায়িত্ব।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

এসইউ/এমএস