ধর্ম

ঈদুল ফিতর: মহিমান্বিত এক উৎসব

ঈদুল ফিতর: মহিমান্বিত এক উৎসব

মাওলানা ইলিয়াস মশহুদ

Advertisement

ঈদুল ফিতর ইসলামের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার দিন হিসেবে উদযাপিত হয়। রমজানের দীর্ঘ এক মাস সিয়াম-সাধনার পর এই দিনটি আসে পুরস্কার ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে। এটি শুধু উৎসব নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে গভীর তাত্ত্বিক তাৎপর্য, যা ইসলামের মৌলিক দর্শনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

ঈদুল ফিতর শব্দের অর্থ রোজা ভাঙার উৎসব। ইসলামি শরিয়তে ঈদের ধারণা কেবল আনন্দ উদযাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি আত্মশুদ্ধি, সামাজিক সংহতি, ও খোদাপ্রাপ্তির প্রতীক। কোরআন ও হাদিসে এই দিবসের গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।

আল্লাহর অনুগ্রহ: রমজান মাস হলো আত্মসংযম ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রশিক্ষণের সময়। এক মাসের সিয়ামের মাধ্যমে মুসলমানরা নিজেদের প্রবৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে। ঈদুল ফিতর সেই ত্যাগ ও সংযমের প্রতিদান হিসেবে আসে, যেখানে আল্লাহ নিজেই বান্দাদের জন্য আনন্দের আয়োজন করেন।

Advertisement

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, আর যখন আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তখন (বলো) আমি তো কাছেই আছি। আমি প্রার্থনাকারীর দোয়া কবুল করি, যখন সে আমাকে ডাকে। (সুরা বাকারা: ১৮৬)

এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, রমজান ও এর পরবর্তী সময়ে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও দোয়ার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ করা যায়। ঈদুল ফিতর সেই দোয়া কবুলের একটি প্রতীকী দিন।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, তোমরা ঘোষণা করো, এটি আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম। (সুরা ইউনুস: ৫৮)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেন, রমজানের রহমত ও মাগফিরাত পাওয়ার পর ঈদুল ফিতর হলো সেই আনন্দের প্রকাশ।

Advertisement

তাকওয়ার পুরস্কার: ঈদ মানেই নিছক ভোগ-বিলাস নয়; বরং এটি আত্মশুদ্ধির একটি উপলক্ষ্য। রমজানের শিক্ষা হলো আত্মসংযম, বিনয় ও সহমর্মিতা অর্জন করা। ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে মানুষ একে অপরকে ক্ষমা করে, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং মানবতার কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত রাখার অঙ্গীকার করে।

আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন, আর তোমরা যেন সংখ্যা পূর্ণ করো (রমজানের) এবং আল্লাহ তোমাদের যা পথ দেখিয়েছেন, তার জন্য যেন তোমরা তাঁকে মহিমান্বিত করো, আর যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (সুরা বাকারা: ১৮৫)

রমজান শেষে মুসলমানরা ঈদুল ফিতর উদযাপন করে তাকওয়ার প্রশিক্ষণ সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

পবিত্র কোরআনের বর্ণনার পাশাপাশি ঈদুল ফিতর নিয়ে বহু হাদিস রয়েছে, যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদের গুরুত্ব, করণীয় ও এর সামাজিক তাৎপর্য সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন:

ঈদের দিন আনন্দ করা সুন্নত: রাসুল (সা.) বলেন, রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে: (১) যখন সে ইফতার করে (রমজান শেষে ঈদের দিন), এবং (২) যখন সে তার রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। (সহিহ বুখারি: ১৯০৪, সহিহ মুসলিম: ১১৫১)

ঈদের তাকবির ও নামাজ: হজরত আনাস (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) ঈদের দিন কিছু না খেয়ে ঘর থেকে বের হতেন না। তিনি ঈদের নামাজের আগে কিছু খেজুর খেতেন এবং বিজোড় সংখ্যা খেতেন। (সহিহ বুখারি: ৯৫৩)

এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, ঈদের দিন সকালবেলা খেজুর বা মিষ্টিজাতীয় কিছু খাওয়া সুন্নত।

ঈদগাহে গিয়ে জামাতে নামাজ আদায়ের নির্দেশ: ঈদুল ফিতরের দিন মুসলিমরা একই কাতারে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় করে। এটি ইসলামের সামষ্টিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত বিভাজন ভুলে সবাই মিলে আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, যা ইসলামের সার্বজনীন সংহতির শিক্ষা দেয়।

ঈদুল ফিতর শুধুমাত্র একটি পার্থিব আনন্দের উৎসব নয়; বরং এটি আত্মশুদ্ধি, সামাজিক সাম্য ও নৈতিক উন্নতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ইসলাম যে সাম্য, সংহতি ও মানবপ্রেমের শিক্ষা দেয়, ঈদুল ফিতর তারই এক প্রতিফলন। তাই ঈদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কেবল পোশাক-আশাকে নতুনত্ব আনা নয়, বরং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা, সমাজের দরিদ্র ও বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়ানো এবং ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধের চর্চা করা।

আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহে যেতেন এবং সর্বপ্রথম নামাজ আদায় করতেন। তারপর তিনি খুতবা দিতেন এবং মানুষকে উপদেশ দিতেন। (সহিহ বুখারি: ৯৫৬)

ঈদের জামাতে ধনী-গরিব, মালিক-শ্রমিক সবাই একই কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে। এটি সামাজিক বিভেদ দূর করে মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে।

সদকাতুল ফিতর আদায় করা: ঈদুল ফিতরের অন্যতম প্রধান নির্দেশনা হলো সদকাতুল ফিতর প্রদান করা। এটি মূলত অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার একটি উপায়, যা দরিদ্রদের ঈদের আনন্দে শরিক করতে বাধ্য করে। ইসলামে সম্পদ কেবল নির্দিষ্ট শ্রেণির হাতে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজের সকল স্তরে ন্যায়সংগতভাবে বণ্টনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) সদকাতুল ফিতরকে ওয়াজিব করেছেন, যাতে রোজাদারদের জন্য এটি পবিত্রতার মাধ্যম হয় এবং গরিব-মিসকিনদের খাদ্যের ব্যবস্থা হয়। (সুনানে আবু দাউদ: ১৬০৯)

এ থেকে বোঝা যায়, ঈদুল ফিতর শুধু ব্যক্তিগত আনন্দ নয়; বরং এটি দরিদ্রদের মুখে হাসি ফোটানোর উপলক্ষ্যও।

রমজান মাসে যে সংযম ও আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা হয়, ঈদুল ফিতর সেই অর্জনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও উদযাপন। এটি আত্মার প্রশান্তি ও আল্লাহর নৈকট্যের প্রতীক।

ঈদ হলো আল্লাহর দেওয়া রহমতের জন্য শুকরিয়া আদায়ের দিন। রমজানের প্রশিক্ষণের পর ঈদ আমাদের জীবনে আল্লাহর বিধান মেনে চলার নতুন প্রত্যয় জাগ্রত করে।

কোরআন ও হাদিসে ঈদুল ফিতরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা তাকওয়ার পুরস্কার, গরিবদের প্রতি সহানুভূতি এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতিফলন ঘটায়। তাই আমাদের উচিত ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করে এর শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা, যাতে ঈদের আনন্দ কেবল ব্যক্তিগত না থেকে সামগ্রিক কল্যাণের মাধ্যম হয়ে ওঠে।

ওএফএফ/জেআইএম