আজ থেকে আট-দশ বছর আগেও ঈদ এলে দোকানে সাজানো থাকতো বাহারী রঙের ঈদকার্ড। পাঁচ টাকা থকে শুরু করে ১০০ টাকায় বিক্রি হতো সেসব। নানা বয়সী মানুষের ব্যাপক চাহিদা ছিল ঈদকার্ডে। তবে এখন মানুষ আর ঈদকার্ড কেনেন না। মোবাইলেই কৃত্রিমভাবে শুভেচ্ছা ও ভাব আদান প্রদান করেন।
Advertisement
শনিবার (২৯ মার্চ) দুপুরে কথা গুলো বলছিলেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী শহরের গণমোড় এলাকার পদ্মা কসমেটিকসের প্রোপাইটর সুকুমার সাহা।
তার ভাষ্য, প্রায় ৩৫ বছর ধরে কসমেটিকসের ব্যবসা করছেন। বর্তমানে তার দোকানে অন্তত দুই হাজার ধরনের পণ্যের পসরা রয়েছে। তবে সেখানে নেই ঈদকার্ড।
‘বন্ধু তুমি অনেক দুরে। তাইতো তোমায় মনে পড়ে। সুন্দর এই সময় কাটুক খুশিতে, সব কষ্ট ভুলে যেও আপনজনের হাসিতে।’ ‘বাকা চাঁদের হাসিতে, দাওয়াত দিলাম আসিতে। আসতে যদি না পারো ঈদ মোবারক গ্রহণ করো।’ ঈদকে ঘিরে প্রায় এক যুগ আগেও এসব বানী লেখা ঈদ কার্ডের জন্য অধির আগ্রহে সময় গুণতেন প্রিয়জন, বন্ধু, বান্ধবরা। কে কাকে আগে ঈদের কার্ড দেবেন এ নিয়েও চলতো প্রতিযোগিতা। প্রিয়জনের কার্ড ছাড়া যেন ঈদের আনন্দ জমতো না।তবে কালের বিবর্তনে আর মোবাইলের ফোনের কাছে হেরে গেছে বন্ধু ও প্রিয়জনদের প্রতি আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের এই মাধ্যম। এখন হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে চলছে কৃত্রিম অনুভূতির আদান প্রদান।
Advertisement
কুমারখালী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ সিদ্দিক বলেন, ছোটবেলায় ঈদ আসার আগে কার্ড কেনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। খুব কাছের বন্ধু-বান্ধবীদের কার্ড দিতাম। অনেক সময় শত্রুদেরও দিতাম। কার্ড না দিলে বন্ধুরা অভিমান করে থাকতো। কার্ড ছাড়া যেন ঈদই হতো না।
কুমারখালী শহরের সোনাবন্ধু সড়কের হলবাজার, গণমোড়, থানামোড়, পাবলিক লাইব্রেরি এলাকার ধ্রুবতারা, পদ্মা, কৃষ্ণ গোপাল, অনন্যা, মীমসহ অন্তত ২০টি কসমেটিকস ঘুরে দেখা গেছে, দোকানে সাজানো হাজারো পণ্যের পসরা। তবে সেখানে ঈদকার্ড নেই।
ধ্রুবতারা কসমেটিকসের স্বত্তাধিকারী স্বপন হোসেন বলেন, অনেক বছর হলো ক্রেতারা ঈদকার্ড চান না। বিক্রিও হয় না। সেজন্য এগুলো আর দোকানে তোলা হয় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, ১০-১৫ বছর আগেও ঈদ কার্ডের প্রচলন ছিল। ছোটবেলায় অনেক কার্ড পেয়েছি।
Advertisement
অন্যদিকে কুমারখালী আদর্শ মহিলা ডিগ্রী কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী জানান, ঈদ কার্ড কি জানেন না তিনি। কখনও দেখেননি। চিঠিও লেখা হয়নি কোনোদিন।
স্থানীয় কবি ও নাট্যকার লিটন আব্বাস জানান, নব্বইয়ের দশকে ঈদকার্ডের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। কার্ড কেনার জন্য সারাবছর এক-দুই টাকা করে গোছানো হতো। ঈদকার্ড সংগ্রহ করে তাতে নিজস্ব অথবা কোনো বিখ্যাত কবির কয়েকটি লাইন লিখে প্রিয়জনকে দাওয়াত দেওয়া হতো। তবে মোবাইলের কারণে ঈদকার্ড আর চলে না। বাঙালির সংস্কৃতি হিসেবে পুনরায় ঈদকার্ড চালু হওয়া দরকার।
জানা গেছে, অনলাইনে দেখে অনুপ্রেরিত হয়ে এবার বেশকিছু ঈদকার্ড কিনে গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নূর ই সিয়াম উচ্চারণ। তিনি বলেন, ২০১৩ সালের দিকে চাচাতো বোন প্রথম ঈদকার্ড দিয়েছিল। আর দেওয়া-নেওয়া হয়নি। তবে এবার বেশকিছু কিনেছি প্রিয়জনদের দেওয়ার জন্য। প্রাচীন এই সংস্কৃতি আবারও ফিরিয়ে আনতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
কুমারখালী সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জিল্লুর রহমান মধু বলেন, কাগজে-কলমে লিখে মনের যে ভাব প্রকাশিত হয়, তা যান্ত্রিকরণের মাধ্যমে হয় না। একটা সময় হালখাতা কার্ডের প্রচলন ছিল। তেমনি ভাবে ঈদে ঈদকার্ড ছিল। এখন কালের বিবর্তনে সবই হারিয়ে গেছে। তবে নতুন প্রজন্মের মাঝে প্রাচীন এসব সংস্কৃতি আবার জাগ্রত করা উচিৎ।
আল-মামুন সাগর/এমএন/জেআইএম