সাহিত্য

নজরুল ইসলামের কবিতায় ঈদুল ফিতর

নজরুল ইসলামের কবিতায় ঈদুল ফিতর

শাহ বিলিয়া জুলফিকার

Advertisement

দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে আমাদের মাঝে আসে ঈদুল ফিতর। ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব। ঈদুল ফিতরে জনমনে থাকে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের ঢেউ। ঈদের আগের দিন থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি। সর্বত্র বাজতে থাকে কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান— ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে,এলো খুশির ঈদতুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দেশোন আসমানি তাগিদ।’

কাজী নজরুল ইসলাম কবি, আমাদের জাতীয় কবি। বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে তাঁর রয়েছে যথেষ্ট অবদান। রয়েছে সব শাখায় বিচরণ। তিনি লিখেছেন অনেক ইসলামি কবিতা ও গজল। তাঁর ইসলামি লেখাসমূহের মধ্যে ঈদ নিয়ে লেখা কবিতা, গজলগুলো বাংলা সাহিত্যে এবং আমাদের হৃদয়ে বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। কারণ বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো কেউ ঈদ নিয়ে এত লেখালেখি করেননি। বাংলা সাহিত্যে ঈদ নিয়ে নজরুলই এককভাবে সবচেয়ে বেশি রচনা করেছেন। ‘শহীদী ঈদ’, ‘ঈদের চাঁদ’, ‘কৃষকের ঈদ’, ‘বকরীদ’, ‘ঈদ-মোবারক’, ‘জাকাত লইতে এসেছে ডাকাত চাঁদ’, ‘কোরবানি’, ‘আজাদ’ এগুলো তাঁর ঈদের কবিতা। তাছাড়া নজরুলের ঈদ বিষয়ক গানগুলো হলো—‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’, ‘নতুন ঈদের চাঁদ’, ‘চলো ঈদগাহে’, ‘ঈদ ঈদ ঈদ’, ‘নাই হল মা বসন-ভূষণ এই ঈদে আমার’, ‘ছয় লতিফার ঊর্ধ্বে আমার আরাফাত ময়দান’, ‘ঈদুজ্জোহার তকবির শোনো’, ‘ঈদ মোবারক হো’, ‘ঈদের খুশির তুফানে আজ ডাকল কোটাল বান’, ‘ফুরিয়ে এল রমজানেরই মোবারক মাস’, ‘নতুন চাঁদের তকবির, ঈদুজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ’, ‘দে জাকাত দে জাকাত, তোরা দেরে জাকাত’, ‘ঈদ মোবারক হোক ঈদ মোবারক হোক’, ‘ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক’। তাছাড়া ‘ঈদজ্জোহা’ ও ‘ঈদুল ফেতর’ নামক দুটি নাটিকাও আছে।

দীর্ঘ এক মাস রোজা শেষে পশ্চিম আকাশে যখন এক ফালি চাঁদ দেখা যায়, মানুষের মনে তখন আনন্দের জয়ধ্বনি। এ জয়ধ্বনি কবি প্রকাশ করেন তার কবিতার ভাষায়। বলেন—‘এল ঈদুল ফিতর এল ঈদ ঈদ ঈদ সারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল না ক’ নিদরোজা রাখার ফল ফলেছে দেখ রে ঈদের চাঁদসেহরি খেয়ে কাটল রোজা, আজ সেহেরা বাঁধ।’

Advertisement

রোজার আত্মশুদ্ধি ও ধৈর্য পরীক্ষা শেষে ঈদ অনেক আনন্দ নিয়ে আসে। সেই আনন্দই কবি তাঁর কবিতায় প্রকাশ করেন—‘ফিরদৌসের শিরনি এল ঈদের চাঁদের তশতরিতে লুট করে নে বনি আদম ফেরেশতা আর হুরপরীতেচোখের পানি হারাম আজি চলুক খুশির আতসবাজি।’

ধনী-গরিব সবার জন্যই ঈদ, সবাই চান ঈদ। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত অনেক কৃষক, মজুর বা গরিব মানুষ আছেন; যাদের জন্য ঈদ খুশি নিয়ে আসে না। যদিও তারা খুশি থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। নজরুল তাদের দুঃখ-কষ্টও বুঝতেন। তাদের কষ্ট তুলে ধরেছেন নিজ কবিতায়। বলেছেন—‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদমুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’

কবি এমন ঈদ প্রত্যাশা করতেন; যেখানে ধনী-গরিব সবাই আনন্দে থাকবে, ঘুচে যাবে সব বৈষম্য। এ নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি লিখেছেন— ‘সিঁড়িওয়ালাদের দুয়ারে এসেছে আজচাষা-মজুর ও বিড়ি-ওয়ালামোদের হিসসা আদায় করিতে ঈদেদিল হুকুম আল্লাহতালাদ্বার খোল সাততালা-বাড়িওয়ালা দেখ কারা দান চাহে মোদের প্রাপ্য নাহি দিলে যেতে নাহি দিব ঈদগাহে।’

আরও পড়ুন

Advertisement

বীরেন মুখার্জীর কবিতায় সম্মোহন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় কবি আল মাহমুদকে স্মরণ

কারো কাছ থেকে সাহায্য না পাওয়ায় কবি গরিব-অসহায়দের সান্ত্বনা দিতেও সংকোচ বোধ করেননি। কবি নিজেকে অভাবী শ্রেণিদের প্রতীক ভেবে কবিতায় বলেন—‘নাই হলো মা বসন-ভূষণ এই ঈদে আমারআল্লাহ আমার মাথার মুকুট রসুল গলার হার।।নামাজ রোজা ওড়না শাড়ি ওতেই আমায় মানায় ভারীকলমা আমার কপালের টিপনাই তুলনা তার।।’

গরিব-অসহায় শ্রেণিদের কষ্টে ঈদ অতিবাহিত করার প্রধান কারণ ধনী ব্যক্তিরা গরিবদের পাশে না দাঁড়ানো। বেশিরভাগ ধনীই ভুলে যায় মানবতা, ভুলে যায় ইসলামের শিক্ষা। কেননা ইসলাম মানবতার কথা বলে, শান্তির কথা বলে, বলে সমব্ণ্টনের কথাও। তাই কবি ইসলামের বাণী স্মরণ করিয়ে দিয়ে কবিতার ভাষায় বলেন—‘ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,সুখ-দুখ সম-ভাগ ক’রে নেব সকলে ভাই,নাই অধিকার সঞ্চয়ের।কারো আঁখি-জলে কারো ঝাড়ে কিরে জ্বলিবেদীপ?দু’জনার হবে বুলন্দ-নসিব, লাখে লাখে হবে বদনসিব?এ নহে বিধান ইসলামের।।’

সমাজের বিত্তবান ও ধনিক শ্রেণির উচিত মানবিক হওয়া, ভ্রাতৃত্বের আদর্শকে সমুন্নত রাখতে অভাবীদের নিয়ে ভাবা, সাহায্য করা ও ইসলামি শিক্ষা অনুযায়ী চলা। তাহলেই আশা করা যায়, সাহায্য ও দান করার মাধ্যমে তাদের অভাব লাঘব হবে।নজরুল এ প্রসঙ্গে বলেছেন—‘ঈদ্-অল-ফিতর আনিয়াছে তাই নব বিধান,ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান,ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার!ভোগের পিয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,তৃষ্ণাতুরের হিসসা আছে ও পিয়ালাতে,দিয়া ভোগ কর, বীর, দেদার।’

ইসলামে অভাবিকে খাবার খাওয়ানো মানে আল্লাহকে খুশি করা। হাদিসেও বিস্তারিতভাবে তা আলোচনা করা হয়েছে। যে আল্লাহকে খুশি করতে পারবে, তার ঈদ হবে শ্রেষ্ঠ ঈদ। কাজী নজরুল ইসলাম ঈদ নিয়ে দুটি নাটিকা রচনা করেছিলেন। ‘ঈদ’ নাটিকায় মাহতাবের কণ্ঠে বলেন—‘আমি আল্লাহকে পেলাম। তারই অস্তিত্ব তাঁরই ইচ্ছার সৃষ্টি তোমাদের সকলকে পেলাম। তাই, আমার ঈদ ফুরায় না, আমার ঈদ ফুরায় না, আবার আসে।’

তাই আমাদের উচিত, নজরুলের কবিতায় উজ্জীবিত হয়ে গরিব অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। ধনী-গরিব বৈষম্যহীন এক ঈদ উদযাপন করা। যে ঈদে আমরা পরস্পরকে বলবো, ‘ঈদ মোবারক’। এ নিয়ে কবি নজরুল বলেছেন—‘পথে পথে আজ হাঁকিব, বন্ধু,ঈদ-মোবারক! আসসালাম!ঠোঁটে ঠোঁটে আজ বিলাব শিরনী ফুল-কালাম!বিলিয়ে দেওয়ার আজিকে ঈদ।আমার দানের অনুরাগে-রাঙা ঈদগা’ রে!সকলের হাতে দিয়ে দিয়ে আজ আপনারে—দেহ নয়, দিল হবে শহীদ।।’

এসইউ/এমএস