দেশজুড়ে

কেবল শ্রদ্ধা জানাতে পরিষ্কার হয় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্থাপনা

কেবল শ্রদ্ধা জানাতে পরিষ্কার হয় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্থাপনা

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন হলেও অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে রাজবাড়ীর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্থাপনাগুলো। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দিন দিন নষ্ট হচ্ছে এসব অবস্থানের অবকাঠামোসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। স্বাধীনতা দিসবসহ বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসের আগে কেবল শ্রদ্ধা জানাতে এসব স্থাপনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়।

Advertisement

রাজবাড়ীতে একাত্তরের স্মৃতিসংবলিত স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সদর উপজেলার মুলঘর এরেন্দার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ। ৫ আগস্টের পর থেকে এই স্থানটি হয়ে পড়েছে অরক্ষিত। রাতে বসে এখানে মাদকসেবী ও বখাটের আড্ডা। চুরি হয়েছে স্মৃতিসৌধের বৈদ্যুতিক মোটর, টিউবওয়েল ও লাইট এবং দেখভাল না করায় ময়লা-আবর্জনায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে স্মৃতিসৌধ। গত বিজয় দিবসেও হয়নি শ্রদ্ধা নিবেদন। এ অবস্থায় ভবিষৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে স্মৃতিস্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণসহ দেখভালের জন্য লোক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

রেলের শহর হওয়ার সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজবাড়ী মুক্ত করতে বেগ পেতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। এখানে ছিল প্রায় ২০ হাজারের বেশি অবাঙালি বিহারিদের বসবাস এবং যুদ্ধের সময় তাদের সঙ্গে যোগ দেয় মিলিটারি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস। এছাড়া তারা ছিল সশস্ত্র। যে কারণে রাজবাড়ীকে শত্রু মুক্ত করতে বেগ পেতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের।

আরও পড়ুন

Advertisement

সহযোগীদের ওপরে তোলা হয়েছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নিচে পড়ে গেছেন ৭১ থেকে ২৫, বৈষম্য কি ঘুচলো?

যুদ্ধকালীন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাকাউল আবুল হাশেম যুদ্ধের সময় ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে রাজবাড়ী সদর উপজেলার মুলঘর এরেন্দার দত্তবাড়ীতে গড়ে তোলেন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ক্যাম্প ও স্থাপন করেন প্রশিক্ষণ শিবির। পরে সেখানে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ গঠিত গেরিলাযোদ্ধা দল রাজবাড়ীর বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনী এবং তাদের দোসর অবাঙালি, বিহারি, রাজাকার ও আলশামসদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করে ১৮ ডিসেম্বর রাজবাড়ী শত্রুমুক্ত করতে অবদান রাখেন। পরে রাজবাড়ীতে স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী হিসেবে এরেন্দা দত্তবাড়ী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের স্মৃতি রক্ষার্থে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় এবং সেটি ২০২০ সালে বাস্তবায়ন করেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর রাজবাড়ী সদর। উদ্বোধন করেন তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী। এরপর বিভিন্ন সময় এখানে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণসহ সভা হলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে কেউ আসেননি এখানে এবং নেননি স্মৃতিসৌধের খোঁজ-খবর।

কেবল দিবস এলে গুরুত্ব বাড়ে এসব স্থাপনার-ছবি জাগো নিউজ

এদিকে রাজবাড়ী জেলা শহরের রেলগেটে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, বাস টার্মিনালে স্মৃতি নামফলক, লোকোশেড বধ্যভূমি, লক্ষ্মীকোল, নিউকোলনীসহ বিভিন্ন স্থানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনা।

এরেন্দা মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ এলাকার দীপালি রাণী দত্ত, অনিমা দত্ত ও জীবন বষু বলেন, এখন এই স্মৃতিসৌধ দেখার কেউ নেই। এটা দেখার জন্য একজন দায়িত্ববান মানুষ দরকার। ৫ আগস্ট এখানকার মোটর, টিউবওয়েল, লাইট ভেঙে নিয়ে গেছে। বাথ রুমে ময়লা, সন্ধ্যার পর এখানে আড্ডা হয়। তবে কি হয় না হয় জানি না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখানে কেউ আসেনি। এর আগে আসতো। আমরা চাই আমাদের পূর্বপুরুষের দান করা সম্পত্তিতে স্থাপিত এই স্থাপনা রক্ষা করা হোক। সরকারসহ সবাই দায়িত্ব নিয়ে এটা রক্ষা করবে এবং দেখাশোনা করার জন্য নির্দিষ্ট করে একজন লোক নিয়োগ দিতে হবে।

Advertisement

আরও পড়ুন

বিএনপির জন্য এবার স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের পরিবেশ কেমন? গৌরবময় স্বাধীনতার ৫৫ বছর

জমিদাতা পিযুষ কুমার দত্তের চাচা প্রীতিশ কুমার দত্ত বলেন, আমার ঘরে মুক্তি ক্যাম্প ছিল, এখানে ট্রেনিং হতো। বাকাউল সাহেব মানুষকে ট্রেনিং দিয়ে বাইরে পাঠাতো। তখন অনেকে এখানে আসতো ও যেত। যুদ্ধের এই ক্যাম্পের স্মৃতি ধরে রাখতে আমাদের জমিতে পাঁচ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এখন এটা কেউ দেখাশোনা করে না, সংস্কার নাই। আগে মাঝেমধ্যে অনেকে আসতো, কিন্তু এখন কেউ আসে না। রাতারাতি এখানকার জিনিসপত্র লুটপাট হয়ে গেছে। এগুলো পুনরায় ঠিক করে দেখাশোনার জন্য একজনকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী ইমরান বলেন, রাজবাড়ী জেলা শহরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্থাপনা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এগুলোর বেহাল দশা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত অনেক স্থাপনার অনেক জিনিস খুলে নিয়ে গেছে। আমার নিজের হাতে গড়া এরেন্দা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধের মোটর, লাইটসহ অনেক কিছু খুলে নিয়ে গেছে, যা খুবই দুঃখজনক। এভাবে সব বেহাত হয়ে গেলে আগামীতে জাতি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ কী জানতে হলে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন আছে। তাই প্রশাসনসহ সচেতন ব্যক্তিদের এগুলো রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।

এই স্থাপনাগুলো যেন নষ্ট হয়ে না যায়-ছবি জাগো নিউজ

যুদ্ধকালীন কমান্ডার যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা বাকাউল আবুল হাশেম বলেন, যুদ্ধের সময় আমার প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল রাজবাড়ী শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে মুলঘরের এরেন্দা দত্তবাড়ীতে। ভারতে প্রশিক্ষণের পর ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে হেঁটে দেশে প্রবেশ করি। প্রথমে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি, তারপর এরেন্দা দত্তবাড়ীতে এসে অবস্থান নেই। আমার ক্যাম্পে স্থানীয়রাসহ ছাত্র, যুবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। যুদ্ধের সময় আমার টার্গেট ছিল রাজবাড়ীর নিউকোলনী, লোকোকোলনী, ২৮ কোলনীসহ রেলগেট এলাকা। কারণ এসব স্থানে অবাঙালি, বিহারি, রাজাকার, আলশামসদের বসবাস ছিল।

তিনি আরও বলেন, দেশ স্বাধীনের পর রাজবাড়ীর বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনা হলেও এখন এগুলোর অনেকটাই বেহাল দশা। এসব স্থানে কোনো গার্ড বা দেখাশোনার কেউ নেই। বিশেষ দিনগুলো উদযাপনের সময় এগুলো দেখাশোনা করা হয়। তাছাড়া পুরো বছর এগুলো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে।

রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বলেন, রাজবাড়ীতে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক স্মৃতিচিহ্ন স্থাপনা, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, রেলগেট, লোকোশেড বধ্যভূমি, লক্ষীকোল ও নিউকোলনী গণপূর্তের মাধ্যমে নতুন করে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছি। এগুলো দেখভাল শুধু জেলা প্রশাসনের নয়, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্মৃতি স্থাপনাগুলো ভালো রাখা সম্ভব। এগুলো ভালো রাখতে আমার নিজের দপ্তরের সবাইকে সচেতন করার পাশাপাশি অন্যদের অনুপ্রাণিত করবো।

এবার স্বাধীনতা দিবসে জেলা শহরের পাঁচটি স্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণের সিদ্ধান্তের কথাও জানান তিনি।

আরইউআর/এসএইচএস/জেআইএম