১৯৭১ থেকে ২০২৫। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই চলছেই। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা যায়নি। মানুষে মানুষে বৈষম্য, শ্রেণি বৈষম্য এখনো সর্বত্র। কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক মুক্তি মেলেনি। ফলে মানুষে মানুষে বৈষম্য বেড়েছে। গরিব আরও গরিব হয়েছে। ধনী আরও ধনী হয়েছে।
Advertisement
বিশিষ্টজনরা বলছেন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই অনেক বড় ব্যাপার। এক-দুদিনে সমাজের সর্বস্তর থেকে বৈষম্য বিলোপ সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে কাজ হচ্ছে। খুব উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি। তবে হয়তো সদিচ্ছা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে ভালো কিছু হবে।
স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় যেভাবেদীর্ঘ প্রত্যাশা ও দাবির ফলে ১৯৪৭ সালে মুসলিমদের একটি রাষ্ট্র হয়। কিন্তু দেশ গঠনের ২৫ বছরের মধ্যে তার মৃত্যুও হয়। কারণ ছিল- বৈষম্য আর শোষণ। ইতিহাস বলে, পাকিস্তান গঠনের ভূমিকা পালনকারী শীর্ষ নেতারা দেশের পশ্চিমাংশে ঘাঁটি গাড়েন, শাসন ক্ষমতাও সেখানেই কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। অথচ বৈষম্যের শিকার হয় জনসংখ্যাধিক্যের পূর্বাংশই। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে দেশের এই অংশের নাগরিকদের প্রতি পদে পদে বৈষম্য।
আরও পড়ুন দুর্নীতিতে বৈষম্য বৈষম্যে দুর্নীতি আর্থ-সামাজিক বৈষম্য হ্রাসে সরকারকে জোর দিতে হবে ইসলামে বৈষম্য দূর করার দিকনির্দেশনা রয়েছে: বায়তুল মোকাররমের খতিব প্রশাসন ক্যাডার নির্ভরতা কমিয়ে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের দাবি বৈষম্য তৈরি করলে সম্মিলিতভাবে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন: মান্না১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দুই অংশে মাথাপিছু আয় ছিল সমান। ১৯৭১ সালে পশ্চিমের মানুষের আয় পূর্বের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। জনসংখ্যায় বেশি হলেও পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৫০-৫৫) কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দের মাত্র ২০ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৬৫-৭০) সেই বরাদ্দ বাড়লেও তা হয়েছিল ৩৬ শতাংশ।
Advertisement
ওই ২৫ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগের অভাবে শত শত স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু পশ্চিমে বেড়ে গেছে তিনগুণ। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে, সেনাবাহিনীর উঁচু পদে বাঙালিদের নিয়োগ পাওয়া খুব কঠিন ছিল। সেই সঙ্গে বিনিয়োগে অবহেলার কারণে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল পশ্চিমের কল-কারখানার কাঁচামালের জোগানদাতা এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রধান ক্রেতা।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল তার ‘ডেডলি এমব্রেস’ বইতে লিখেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই ‘পাকিস্তানের কাছে বাংলার গুরুত্ব ছিল দ্বিতীয়’ এবং বাঙালিদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ হিসেবে দেখা হতো।
আরও পড়ুন বৈষম্য দূরীকরণে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের মানববন্ধন সামাজিক বৈষম্য ও গণতান্ত্রিক সংস্কার বৈষম্য নিরসনে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর বিকল্প নেই বৈষম্য অবসানে বিশ্বনেতাদের একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান ড. ইউনূসের ভ্যাট বৈষম্য দূর করলে সরকারের টাকার অভাব হবে নাচলমান বৈষম্য ও এর প্রতিবাদ করলেই চলতো নিপীড়ন। ফলে ১৯৭১ সালে ৯ মাসের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান রূপ নেয় স্বাধীন বাংলাদেশে।
স্বাধীনতার ৫৫ বছরেও ঘুচেছে বৈষম্য?২৬ মার্চ। স্বাধীন বাংলাদেশ ৫৫ বছরে পদার্পণ করেছে আজ। সেই বৈষম্য কি ঘুচেছে? ঘটনাপ্রবাহে স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষ জীবন দিয়েছে। অঙ্গহানিসহ আহত হয়েছে অর্ধলাখ মানুষ। পতন হয়েছে টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা শেখ হাসিনা সরকারের।
Advertisement
এরপরও কি বৈষম্য বিলুপ্ত হয়েছে? জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৯৭১ সালে যে লক্ষ্য সামনে রেখে লড়াইটা করা হয়েছিল, সেটা তো আমরা অ্যাচিভ করতে পারিনি। লড়াইটা এখনো চালু আছে, যাতে অ্যাচিভ করতে পারি।’
আরও পড়ুন ‘বৈষম্য এখনো দূর হয়নি, সাময়িক স্বস্তি এসেছে’ সমাজে বৈষম্য কমাতে ত্রিভুজ ক্ষমতার বলয় ভাঙার তাগিদ ভিন্নমত সহ্য করতে না পারলে সমাজে বৈষম্য তৈরি হয়: আলী রীয়াজ কওমি শিক্ষার্থীদের বিসিএসে অংশ নেওয়ার সুযোগ না দেওয়া বৈষম্য মৎস্যখাত চরম বৈষম্যের শিকার: প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টামাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী লড়াই অনেক বড় জিনিস। এটা এক-দুদিনে শেষ হবে না। সমাজের সর্বস্তরের বৈষম্য দূর করা অনেক বড় কাজ। এটা করছে ধীরে ধীরে, দেখা যাক। কিছু কিছু অগ্রগতি হয়েছে, খুব সিগনিফিক্যান্ট (উল্লেখযোগ্য) কিছু নয়।’
ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন হয়নি। এখনো মুক্তির স্বাদ পাইনি বা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করা যাচ্ছে না। স্বাধীনতার মূল যে কথা ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি, সেই অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা যায়নি। বরং মানুষে মানুষে বৈষম্য বেড়েছে। দরিদ্র্য আরও দরিদ্র্য হয়েছে। ধনী আরও ধনী হয়েছে।’
‘এর কারণ হচ্ছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে গিয়েছিল বুর্জুয়াদের হাতে। বুর্জুয়ারা যে উন্নতি চায়, সেই উন্নতি হচ্ছে পুঁজিবাদী উন্নতি। বাংলাদেশে পুঁজিবাদী উন্নতি হয়েছে ঠিকই। পুঁজিবাদী উন্নতি বৈষম্য সৃষ্টি করে, বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে, দেশপ্রেমের ঘাটতি তৈরি করে। ফলে সম্পদ পাচার হয়ে গেছে। বড় লোকরা আমাদের দেশের সব সম্পদ পাচার করে বিদেশে নিয়ে গেছে। মানুষ বিশ্বাস করে বা আস্থার ফলে ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখে, সেখানে ব্যাংকাররা নিজেরাই রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা নিয়েছে। নিজেরাই টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। কাজেই নিঃস্বকরণ ঘটেছে।’ বলছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
আরও পড়ুন বৈষম্য দূর করতে রাসুলের আদর্শে রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হবে বৈষম্য দূর করে প্রকৃত গণতন্ত্র ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে ১৫ বছরে চিকিৎসকরাই বেশি বৈষম্যের শিকার: বুলবুল বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশে সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে চাই বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ধনী-গরিবের বৈষম্য থাকবে না: খোকনঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাবের আহমেদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৯৭১-এ আমাদের লড়াইটা ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে, নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে। ২০২৪ সালের লড়াইটাও ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। এটাও নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে। শুধু পার্থক্য বলা যায়, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে একাত্তরে ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সঙ্গে, কিন্তু ধর্ম ছিল এক। আর ২৪-এ জাতি-গোষ্ঠী সব দিক থেকে এক। স্বাধীনতার মূল চেতনাই তো ছিল বৈষম্যের বিলোপ, মানবাধিকার রক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক মুক্তি, বহুত্ববাদ মেনে নেওয়া, মানুষের আকাঙ্ক্ষা মেনে নেওয়া; এগুলো ছিল মূল। স্বাধীনতার পরে আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্রও হয়েছে। আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের কোনো সরকারই মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নজর দেয়নি। দিনের পর দিন শুধু খারাপই হয়েছে। আমরা দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে পারিনি। যে যখন ক্ষমতায় ছিল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে। সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল বিরোধীদের যতটা দমন-পীড়নে রাখা যায়। বহুত্ববাদ আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চায় কেউই বিশ্বাসই করে না।’
এসইউজে/এমএমএআর/এএসএম