অর্গানজা থ্রি পিস- পুরো জামা ও হাতায় কারচুপি কাজসমৃদ্ধ এক ধরনের পোশাক। নারীদের এ পোশাকটি রাজধানীর নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন বিপণিবিতানে বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকায়। ভারত থেকে শাড়ি, থ্রি-পিস, শার্ট, লেহেঙ্গা, প্যান্ট আমদানিতে শুল্কসহ সর্বোচ্চ খরচ পড়ছে মাত্র ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। দেশের বাজারে এসব পোশাক বিক্রি হচ্ছে ১৫ হাজার টাকারও বেশি দামে।
Advertisement
রাজধানীর অভিজাত এলাকার বুটিক হাউজ ও এফ-কমার্সে এ ধরনের পোশাকের দাম আরও বেশি। কোথাও কোথাও ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু ভারত থেকে আমদানি করতে শুল্কসহ সর্বোচ্চ খরচ পড়ছে মাত্র ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। একইভাবে ভারত থেকে আনা শাড়ি, থ্রি-পিস, শার্ট, লেহেঙ্গা, প্যান্ট, লঞ্জরি আমদানিতে খরচ ১৫০০ টাকার বেশি নয়। তবে বেশি শুল্ক ও ভ্যাটের কথা বলে ক্রেতার পকেট কাটছে বিক্রেতারা।
এছাড়া এসব পণ্য যা বৈধভাবে আমদানি হচ্ছে স্থানীয় বাজারে তার চেয়ে বেশি সরবরাহ। যার মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি হচ্ছে। চোরাচালানের মাধ্যমে এসব পণ্য দেশের বাজারে ঢুকছে। ফলে দেশীয় পোশাকখাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের বাজারে প্রাপ্ত শাড়ি, টু-পিস, থ্রি-পিস ও লেহেঙ্গা জাতীয় পণ্য মূলত ভারত থেকে আমদানি হয়ে থাকে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শাড়ি, থ্রি-পিস ও অন্যান্য পোশাকের বাজার সংরক্ষণে বিদেশি কাপড় ও পোশাক আমদানিতে শুল্ক ফাঁকি ও চোরাচালান বন্ধে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে কমিশন।
Advertisement
সংস্থাটি বলছে, দেশে ধারাবাহিকভাবে শাড়ি ও থ্রি-পিস বা লেহেঙ্গা আমদানির পরিমাণ বাড়ছে। প্রতি পিসের গড় শুল্ক মূল্য হিসাব করলে দেখা যায়, আমদানিস্থলে ঘোষিত মূল্য কম। দেশের বাজারে কোনো কোনো বিদেশি শাড়ি ও লেহেঙ্গা লাখ টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অথচ ভারত থেকে আমদানি করা শাড়ি, থ্রি-পিস ও লেহেঙ্গা জাতীয় পণ্য শুল্কসহ সর্বোচ্চ ১২০০ টাকা খরচ পড়ছে। অন্যদিকে, যা বৈধভাবে আমদানি হচ্ছে, স্থানীয় বাজারে তার চেয়ে বেশি সরবরাহ হয়েছে, যার সঙ্গে শুল্ক ফাঁকি বা চোরাচালানের যোগসূত্র রয়েছে।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সিনথেটিক ফাইবার, কটন জাতীয় পোশাক আমদানিতে সর্বোচ্চ খরচ ৫৫০ টাকা থেকে ৭৩৮ টাকা। মেয়েদের ব্লাউজ আমদানিতে খরচ ১ হাজার ৪৬ টাকা, নানান ধরনের টি শার্ট ৫৮০ টাকা থেকে ৬১৬ টাকা, ছেলে ও মেয়েদের নানান সুতি পোশাক আমদানি ব্যয় ৩০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা, ব্লেজার, জ্যাকেট, প্যান্টের সর্বোচ্চ খরচ ৪০০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ ধরনের পণ্য ভারত থেকে কী পরিমাণ আমদানি হয়েছে এবং প্রতি ইউনিটের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশে যে পরিমাণ ভারতীয় শাড়ি, টু-পিস, থ্রি-পিস ও লেহেঙ্গা বিক্রি হয়, সে তুলনায় বৈধভাবে আমদানির পরিমাণ বেশ কম। এসব শাড়ি, টু-পিস, থ্রি-পিস ও লেহেঙ্গা আমদানি পর্যায়ে যে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ঘোষিত হয় তা বাজারজাত করা মূল্যের তুলনায় অনেক কম। এক্ষেত্রে শুল্ক মূল্যায়নসংক্রান্ত বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগের অবকাশ রয়েছে, যাতে শুল্ক মূল্যে প্রকৃত মূল্যকে প্রতিফলিত করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মিথ্যা ঘোষণা বা চোরাচালানের মাধ্যমে এসব পণ্যের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দেশীয় বাজারে প্রবেশ করছে। স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় আমদানি পর্যায়ে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে তা নির্ধারণ, আমদানিকারক কর্তৃক বা ব্যাগেজে আনিত ও ঘোষিত পরিমাণ যথাযথভাবে যাচাই এবং সীমান্তে এসব পণ্যের অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।
Advertisement
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে কাপড়ের চাহিদা প্রায় ৮০০ কোটি মিটার। কাপড়ের এই চাহিদার একটি অংশ দেশীয় তাঁত, হস্তশিল্প ও পাওয়ালুমের মাধ্যমে পূরণ হয়। তবে বিদেশ থেকে বৈধ ও অবৈধভাবে (শুল্ক ফাঁকি ও চোরাচালান) প্রবেশ করা কাপড় ও পোশাকের একটি বড় অংশ দেশীয় চাহিদা মেটায়।
ট্যারিফ কমিশন প্রতিবেদনে জানায়, দেশে সাধারণত ভারত, পাকিস্তান, চীন, মিয়ানমার, হংকং, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, জাপান ও অন্যান্য দেশ থেকে কাপড় আমদানি হয়। গত ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যথাক্রমে ১৩ হাজার কোটি ও ১৩ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকার শাড়ি আমদানি হয়। এরমধ্যে ভারত থেকে আসে যথাক্রমে ২৮২ ও ২৫৮ কোটি টাকার শাড়ি। এ ছাড়া গত ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উল্লিখিত দেশগুলো থেকে যথাক্রমে ২ হাজার ১৭৯ কোটি ও ১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকার টু-পিস, থ্রি-পিস, লেহেঙ্গা ইত্যাদি পোশাক আমদানি হয়। এরমধ্যে ভারত থেকে আমদানি হয় যথাক্রমে ১১৬ ও ৭৬ কোটি টাকার পোশাক।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে গত ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ হাজার ৯৩০ কোটি টাকার শাড়ি আমদানি হয়েছে। তারমধ্যে ভারত থেকে এসেছে ১০৬ কোটি টাকার শাড়ি। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৫৮ কোটি টাকার টু-পিস, থ্রি-পিস, লেহেঙ্গা ইত্যাদি পোশাক আমদানি হয়েছে। এরমধ্যে ভারত থেকে এসেছে ১৭ কোটি টাকার পণ্য।
চোরাচালান বা শুল্ক-ফাঁকি দেওয়া পণ্য জব্দ করতে গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশের কোনো শপিং মল বা মার্কেটে কোনো অভিযান পরিচালনা করা হয়নি বলে জানান কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, বিদেশ থেকে শিশু, বয়স্ক ও বৃদ্ধ ক্যাটাগরিতে পোশাক বা কাপড় আমদানি হয়ে থাকে। অনেক সময় আমদানিকারকরা ক্রয়মূল্যের চেয়ে কম মূল্য প্রদর্শন করেন। প্রাইসিং পলিসি অর্থাৎ, এইচএস কোড ও ভ্যালুয়েশন পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার।
এসএম/এমএএইচ/