দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউজে ফিরেই অভিবাসীদের ওপর চড়াও হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দেশটিতে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের জীবনে যেন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। নির্বাচনী প্রচারণায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে অভিবাসীবিরোধী কঠোরনীতি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন তিনি।
Advertisement
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবস্থা এতটাই বেগতিক যে, একজন ভিসাধারীর চেয়ে বর্তমানে দেশটিতে অপরাধীরা বেশি অধিকার ভোগ করছেন।
অভিবাসীদের গুয়ান্তানামো বে নৌঘাঁটিতে পাঠানো হচ্ছে। আইনি পরামর্শ নেওয়ার সুযোগও দেওয়া হচ্ছে না। এরইমধ্যে ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির খড়গ নেমে এসেছে ফিলিস্তিনপন্থি দুই শিক্ষার্থীর ওপর। তাদের মধ্যে খলিল মাহমুদকে ধরে নিয়ে লুইজিয়ানার একটি আটককেন্দ্র রাখা হয়েছে। তাদেরকে দেশ থেকে বের করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে মার্কিন প্রশাসন।
এছাড়া এল সালভাদরগামী অভিবাসীদের একটি ফ্লাইট ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যা আদালতের নির্দেশের সম্ভাব্য লঙ্ঘন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরইমধ্যে প্রশাসনের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করেছে আদালত।
Advertisement
গত কয়েক সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রগামী পর্যটকদের সীমান্তে আটকে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এতে দেশে-বিদেশে কূটনৈতিক ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। যারা যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে যেতে চাচ্ছেন, তাদের মধ্যে শঙ্কাটা একটু বেশি কাজ করছে।
নিউ ইয়র্কের কারডোজো স্কুল অব ল’-এর অধ্যাপক ও অভিবাসন বিষয়ক আইনজীবী মাইকেল উইল্ডেস বলেন, কেউ যদি সশরীরে যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থিত থেকেও আইনগত অনুমোদন না পান, তাহলে দেশটিতে তিনি উপস্থিত আছেন বলে গণ্য হবেন না। যুক্তরাষ্ট্রে তারা ‘অ্যারাইভিং এলিয়েন’ (আগন্তুক অভিবাসী) হিসেবে পরিচিত হবেন।
মূলত নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প বেশ জোরেশোরেই অভিবাসনবিরোধী নীতির কথা জানান দিয়েছিলেন। এবার তার কথা-কাজে মিল রাখার পালা। ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউজে প্রত্যাবর্তন করেই তিনি খড়গহস্ত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীদের ওপর।
শুক্রবার (২২ মার্চ) মোমোদু তাল নামের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে আত্মসমর্পণ করতে বলেছে মার্কিন অভিবাসন পুলিশ। তার আইনজীবী দলকে এই চিঠি মেইল করা হয়েছে। দেশ থেকে বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মার্কিন অভিবাসন ও শুল্ক কর্মকর্তারা এই চিঠি দেন।
Advertisement
দেশের ভেতরে থাকা অভিবাসীদের না হয় এসব সহ্য করতে হচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের আগে হয়রানিও সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে।
এরই মধ্যে কিছু ঘটনা বিশ্বজুড়ে অনেকের নজর কেড়েছে। কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকালে কানাডীয় ব্যবসায়ী ও অভিনেত্রী জ্যাসমিন মুনি দুই সপ্তাহ আটক ছিলেন। মার্কিন অভিবাসন ও শুল্ক কর্মকর্তারা তাকে আটক করে রাখেন।
আরও একটি আশঙ্কাজনক কথা হলো, কেউ রাজনৈতিকভাবে ট্রাম্পবিরোধী হলেও তাকে হয়রানির মুখে পড়তে হতে পারে। ফ্রান্সের এক বিজ্ঞানী জানান, তার মোবাইলে ট্রাম্পের সমালোচনামূলক কিছু বার্তা পাওয়ায় নাকি তার ভিসা বাতিল করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী কর্মকর্তারা।
এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যখন-তখন আটক হওয়ার ভয় তৈরি করা হয়েছে।
সবমিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইনে কি বলা আছে, কী কী অধিকার রয়েছে অভিবাসীদের, কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে তা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের ক্ষেত্রে করণীয় ও নিয়ম-কানুন নিয়ে আমেরিকান সিভিল লির্বাটিস ইউনিয়ন (এসিএলইউ) নামে একটি অলাভজনক সংগঠন যারা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণে কাজ করে থাকে তারা কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন।
প্রশ্ন: একজন ব্যক্তি সব ধরনের বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও কর্মকর্তারা তাকে তল্লাশি করতে পারেন?অবাক হলেও উত্তরটি হচ্ছে, হ্যাঁ। যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের জন্য বৈধ কাগজপত্র থাকলেও কোনো ভ্রমণকারী কোনো ধরনের সন্দেহজনক কিছু বহন করছে কি না; এটি নিশ্চিত হওয়ার স্বার্থে তাদের ব্যাগপত্র তল্লাশি করতে পারেন অভিবাসন কর্মকর্তারা। এমনকি সন্দেহভাজন মনে না হলেও অভিবাসন কর্মকর্তারা এটি করতে পারেন বলে জানায় এসিএলইউ।
তবে সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী, ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা, লিঙ্গ, নৃতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে কাউকে তল্লাশি করা যাবে না।
প্রশ্ন: ব্যক্তিগত মোবাইলও কী তল্লাশি করা হচ্ছে?সরকারি আইন অনুযায়ী এয়ারপোর্টে সন্দেহজনক কোনো কিছু বহন করা হচ্ছে কি না তা জানতে যেসব জিনিস অনুসন্ধান করা হবে, তার মধ্যে মোবাইল ও ল্যাপটপও রয়েছে। যদিও এটি নিয়ে আইনি বিতর্ক রয়েছে। কখনো-কখনো অভিবাসন কর্মকর্তারা তাদের তদন্তের স্বার্থে মোবাইল বা ল্যাপটপের পাসওয়ার্ডও চেয়ে থাকেন বলে জানিয়েছে এসিএলইউ।
প্রশ্ন: যদি কেউ মোবাইল আনলক করতে অস্বীকৃতি জানান, তখন কী হবে?এসিএলইউয়ের দেওয়া নির্দেশনা মতে, এর ফলাফল মোটেই সুখকর নয়। যদি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিক বা গ্রিনকার্ডধারী তাদের ডিভাইস আনলক করতে অস্বীকৃতি জানান, তবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে তাদের বাধা দেওয়া না হলেও নানা হয়রানির মুখে পড়তে হবে।
যেমন, তাদের ভিসা প্রক্রিয়াকরণে দীর্ঘসূত্রতা, অভিবাসন কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত জেরা, এছাড়া পরবর্তী তদন্তের জন্য তাদের মোবাইল জব্দ করেও নিয়ে যেতে পারেন বলে নিশ্চিত করেছে সংস্থাটি।
তবে ভিসা নিয়ে ভ্রমণকারী বা ভিসা-মুক্ত দেশের তালিকায় থাকা কোনো দেশের নাগরিক যদি তার ডিভাইস আনলক করে দেখাতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে ভিসা বাতিল হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। প্রশ্ন: ভিসা-মুক্ত প্রোগামের আওতাধীন হলে কি প্রবেশ করা যাবে যুক্তরাষ্ট্রে?যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা-মুক্ত প্রোগামের আওতায় প্রায় দুডজন দেশের নাগরিক ৯০ দিনের জন্য ভ্রমণ কিংবা ব্যবসায়িক কাজে ভিসা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরাও একইভাবে ভিসা ছাড়া ওই দেশগুলোতে ৯০ দিনের জন্য ভ্রমণ করতে পারেন।
তবে সেক্ষেত্রে ভ্রমণের অন্তত তিনদিন আগে বৈদ্যুতিন ভ্রমণ কর্তৃপক্ষের (ইএসটিএ) অনুমোদন নিতে হবে বলে নির্দেশনায় উল্লেখ করতে করা হয়েছে। মজার বিষয় হলো, নির্ধারিত সময়ের পরে কিন্তু আর ইএসটিএ অনুমোদন পাওয়া যাবে না। যেমন, কিউবার নাগরিকরা ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারির পর আর কিন্তু ইএসটিএ পাচ্ছেন না।
প্রশ্ন: ইএসটিএ অনুমোদন নিয়ে কি যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করা যাবে?এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য অনুমেয়, এই প্রোগ্রামের আওতায় ভ্রমণকারীরা কোনো ধরনের কাজ করতে পারবেন না। এছাড়া তারা লেখাপড়া করতে পারবেন না যুক্তরাষ্ট্রে। এর বাইরেও তাদের কিছু অধিকার হরণ করা হয়ে থাকে বলে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমন, ভিসা ছাড়াই যারা যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন, তারা দেশটি থেকে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের নিবার্সিত করা হচ্ছে এই বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজন মনে করলে অভিবাসন কর্মকর্তারা ইএসটিএ অনুমোদন থাকা ব্যক্তিদের আটক পর্যন্ত করতে পারেন।
প্রশ্ন: তবে ভিসা নিয়ে কি কাজ করা যাবে?উত্তর হলো, না। স্থায়ীভাবে বা অস্থায়ীভাবে যারা যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী নন, তারা কোনো কাজ করতে পারবেন না, লেখাপড়াও করতে পারবেন না। ভ্রমণকারীরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত বলে নিউ ইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এমনকি যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রক্রিয়াধীনও থাকে, তাও অভিবাসন কর্মকর্তারা ভর্তির অনুমোদন নাও দিতে পারেন। সাধারণত, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী নয় এমন ভ্রমণকারীদের জন্য তিন ধরনের ভিসা রয়েছে। সেগুলো হলো- ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে অস্থায়ী প্রবেশের ভিসা, পর্যটন ভিসা, ব্যবসা ও ভ্রমণ সমন্বিত ভিসা।
এই ভিসাগুলোর মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে, তবে এই ভিসাধারীরা একটানা সর্বোচ্চ ৬ মাসের বেশি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করতে পারবেন না।
প্রশ্ন: আটক হলে করণীয় কি?যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি যে হারে অভিবাসীরা আটক হচ্ছেন, তাতে অভিবাসীদের পাশাপাশি ভ্রমণকারীরাও আতঙ্কে রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে কি করে ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতির দুষ্টচক্র থেকে বের হবেন তা জানতে আগ্রহী অনেকে।
এ বিষয়ে এসিএলইউয়ের পরামর্শ হচ্ছে, যারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরকি নন, কিন্তু অভিবাসী বা ভ্রমণকারী যাই হোক না কেন; একজন অভিবাসী আইনজীবীর তথ্য সংগ্রহ করে রাখতে হবে। যেকোনো সময়ে প্রয়োজন হতে পারে। পরিস্থিতি যেভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছে, তা যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণকারীদের জন্য সত্যিই উদ্বেগজনক বলে অভিমত দিয়েছেন এসিএলইউয়ের আইনজীবী নূর জাফর। এ কারণে আটক হলে অভিবাসন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা মেনে চলা এবং যতদ্রুত সম্ভব একজন অভিবাসন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
প্রশ্ন: যুক্তরাষ্ট্রে তাহলে কি অধিকার আছে একজন ভ্রমণকারীর?যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণকারীদের কেবল নীরব থাকার অধিকার রয়েছে, অবশ্য তাও সবসময় নয় বলে দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ধরা যাক, বিমানবন্দরে একজন ভ্রমণকারীকে প্রশ্ন করা হলো তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করতে চান কি না, এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দেওয়া হলেও ওই ব্যক্তির ভ্রমণভিসা বাতিল হতে পারে।
প্রশ্ন: প্রবেশাধিকার যদি বাতিল হয়েই যায় তখন করণীয় কী?মূলত এক্ষেত্রে কর্তার আদেশেই কর্ম হবে। তার মানে এই যে, যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন কর্মকর্তারা চাইলে ভিসা বাতিল করে নিজ দেশে ফেরতও পাঠাতে পারেন, আবার আটকেও রাখতে পারেন।
সাধারণত আমেরিকার সীমান্তে উপস্থিত হয়ে যদি ভিসা বাতিল হয়, তাহলে ভিসাধারীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়, আবার আটকেও রাখতে পারেন কর্মকর্তারা। কারণ আইন অনুযায়ী, এই ঘটনাগুলো দেশটির সীমানার বাইরে ঘটার কারণে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার তাদের থাকে না। এমনকি সঙ্গে সঙ্গে আইনজীবীও পান না।
আরও পড়ুন: গাজায় হাসপাতালে ইসরায়েলের বোমা হামলা, আরও এক হামাস নেতা নিহত ইসরায়েলি হামলায় লেবাননে ৭ এবং গাজায় ৩৪ জন নিহত লেবানন থেকে ইসরায়েলে দফায় দফায় রকেট হামলাএসব কারণে আইনজীবী ও শিক্ষক মাইকেল উইল্ডস বলেছেন, একজন অপরাধী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যতটুকু অধিকার আপনার আছে, একজন ভিসাধারী হিসেবে সেটুকু অধিকারও নেই।
সূত্র: ইউএনবি
টিটিএন