অর্থনীতি

ঈদের মৌসুমেও আসবাবপত্র বিক্রি হচ্ছে না কেন?

ঈদের মৌসুমেও আসবাবপত্র বিক্রি হচ্ছে না কেন?

• বেশিরভাগ আসবাবপত্রের দোকানেই নেই ক্রেতা, বিক্রিতে ভাটা• দোকানের চেয়ে অনলাইনে আসবাবপত্রের দাম কম, তবে মান ভিন্ন• রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক সংকটে বিলাসী পণ্য কিনছে না মানুষ• দুদক, এনবিআর ও গোয়েন্দা সংস্থার ভয়ে আপাতত দামি আসবাব কিনছেন না অনেকেই

Advertisement

ঈদুল ফিতর সামনে রেখে ক্রেতাদের ভিড়ে জমজমাট রাজধানীর ফুটপাত থেকে শুরু করে বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমলের বিপণিবিতান। সেখানে ক্রেতার ভিড় দেখা গেলেও উল্টো চিত্র আসবাবপত্রের দোকানগুলোতে।

রাজধানীর শেওড়াপাড়া, বাড্ডা ও মিরপুরের আসবাবপত্রের দোকানগুলোতে ক্রেতা খরা দেখা গেছে। বিক্রেতারা পার করছেন অলস সময়। কেউ মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত মাত্র একটি আসবাবপত্র বিক্রি করতে পেরেছেন। কেউ চার-পাঁচদিনে কোনো আসবাবপত্র বিক্রি করতে পারেননি।

বিক্রেতারা বলছেন, সাধারণত ঈদে আসবাবপত্র বিক্রি দ্বিগুণ হয়। তবে এবার বেচাবিক্রিতে ভাটা পড়েছে। গতবার ১৫ রোজার পরে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার আসবাবপত্র বেচাকেনা হয়েছে। এবার তা অস্বাভাবিক কমেছে।

Advertisement

২০ মার্চ বিকেলে শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়ায় আসবাবপত্রের একাধিক দোকান ঘুরে দেখা গেছে, আভিজাত্য ও বাহারি নকশার আসবাবপত্র সাজানো রয়েছে দোকানগুলোতে। বেশিরভাগ দোকানেই নেই ক্রেতা। ক্রেতা না থাকায় অনেকেই অতিরিক্ত কর্মচারী আগেভাগে ছুটি দিয়েছেন বলে বিক্রেতারা জানান।

শেওড়াপাড়ায় আলিফ ফার্নিচারের বাইরে কথা হয় সৌম্য ও বিজরী দম্পতির সঙ্গে। তারা সম্প্রতি পুরান ঢাকা ছেড়ে তালতলায় বাসা নিয়েছেন।

আরও পড়ুন

বেড়েছে ফার্নিচারের দাম, ঈদের বেচাকেনায় ভাটা আসবাবপত্রকে বর্ষসেরা পণ্য ঘোষণা ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের জাকাত দিতে হবে কি? আসবাবপত্র কিনতেই ৩২ কোটি, ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন কমিশনে

বেসরকারি চাকরিজীবী সৌম্য হাসান বলেন, ‘নতুন বাসার জন্য খাট, ডাইনিং টেবিল, সোফা দেখছি। ক্রেডিট কার্ডে নেব। কয়েকটি পছন্দ হয়েছে। আরও ঘুরে দেখে নেব ভাবছি।’

Advertisement

‘দোকানগুলোতে দাম একটু বেশি। ধরেন সিঙ্গেল সোফা ১৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাচ্ছে। অথচ এই দামেই ডাবল সোফা পাওয়া যায় অনলাইনে। ডিজাইন ও ম্যাটেরিয়ালও এক। তাহলে মানুষ কেন কিনবে দোকান থেকে?’- গৃহিণী শাম্মী

শাম্মী নামের এক গৃহিণীকে আরেকটি দোকানে পায়চারী করতে দেখা যায়। তিনি বলেন, ‘দোকানগুলোতে দাম একটু বেশি। ধরেন সিঙ্গেল সোফা ১৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাচ্ছে। অথচ এই দামেই ডাবল সোফা পাওয়া যায় অনলাইনে। ডিজাইন ও ম্যাটেরিয়ালও এক। তাহলে মানুষ কেন কিনবে দোকান থেকে?’

অনলাইনে এবং পুরাতন আসবাবপত্রের বেচাকেনা বেড়ে যাওয়ায় দোকানে বিক্রি কমার অন্যতম কারণ বলে জানান মদিনা ফার্নিচারের ব্যবস্থাপক আলী আহসান। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘অনেকেই কারখানা থেকে বানিয়ে নেন কিংবা নিজেই অনলাইনে অর্ডার নিয়ে বানিয়ে নেন। দামে খুব একটা ফারাক নয়। সব কিছুর দাম বেশি। ভালো উপকরণ দিলে দাম বাড়বে। দেখতে একই জিনিস হলেও উপকরণ কিন্তু এক নয়। কাঠ ও হার্ডবোর্ডের পার্থক্য আছে।’

উদাহরণ দিয়ে আলী আহসান বলেন, ‘ছয় চেয়ারের সেগুন কাঠের টেবিলের দাম ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা। হার্ডবোর্ডের টেবিল হলে দাম ২০ হাজার টাকা কম হবে। একই রকম ডিজাইন হলে তো হবে না, উপকরণ তো ভিন্ন।’

বাজারে কানাডিয়ান উড, মালয়েশিয়ান উড, ওকউড, প্লাইউডের ফার্নিচার পাওয়া যায়, সেগুলো হার্ডবোর্ডের ফার্নিচার বলে অভিহিত করেন এই ব্যবসায়ী। এ ধরনের ফার্নিচারের দামও কম বলে জানান তিনি।

‘পুরো মার্চ মাসে ১৯ তারিখে মাত্র একটা সোফা সেট বিক্রি করতে পেরেছি। আজ সারাদিনে দোকানে কেউ আসেনি। আপনার সঙ্গেই প্রথম কথা হলো।’- মদিনা ফার্নিচারের ব্যবস্থাপক আলী আহসান

টালি খাতা দেখিয়ে আলী আহসান বলেন, ‘পুরো মার্চ মাসে ১৯ তারিখে মাত্র একটা সোফা সেট বিক্রি করতে পেরেছি। আজ সারাদিনে দোকানে কেউ আসেনি। আপনার সঙ্গেই প্রথম কথা হলো।’

আরও পড়ুন

যত্নে থাকুক কাঠের আসবাব অনলাইনে দেড় লাখের ফার্নিচার অর্ডার দিলো ২২ মাসের শিশু! সোয়া দুই লাখ টাকার ‘রাজকীয়’ খাট হারিয়ে যাচ্ছে রাজশাহীর বেতশিল্প

‘জানি না কীভাবে বেতন, বোনাস হবে। কোম্পানি সব জানে। মানুষ বেশি টাকা খরচ করে ভালো ফার্নিচার কিনতে চায় না। তাদের নজর হার্ডবোর্ডের দিকে। অলিগলিতে হার্ডবোর্ডের দোকান।’ যোগ করেন তিনি।

‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক সংকটে মানুষ বিলাসী জিনিসপত্র কেনা কমিয়েছে। ঈদ বাজারে জামা-কাপড় কিনছে কিন্তু বড় খরচ করছে না। রোজা প্রায় শেষ, এবার আশানুরূপ বেচাকেনা হয়নি।’- যমুনা ফার্নিচারের ব্যবস্থাপক শাহাবুদ্দিন

তবে ভিন্ন মত যমুনা ফার্নিচারের ব্যবস্থাপক শাহাবুদ্দিনের। তার মতে এবার বাজারে আসবাবপত্র কেনার ক্রেতা কম। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘মূল্যছাড়, হোম ডেলিভারিসহ নানান সুযোগ-সুবিধা আছে। কিন্তু বেচাকেনা একেবারেই খারাপ। চার-পাঁচদিন ধরে কোনো বিক্রি নাই। গত বছর এত খারাপ অবস্থা ছিল না।’

শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক সংকটে মানুষ বিলাসী জিনিসপত্র কেনা কমিয়েছে। ঈদ বাজারে জামা-কাপড় কিনছে কিন্তু বড় খরচ করছে না। রোজা প্রায় শেষ, এবার আশানুরূপ বেচাকেনা হয়নি।’

বাড্ডা লিংক রোড থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত প্রধান সড়কের দুই পাশে আসবাবপত্র বেচাকেনার অসংখ্য দোকান। এসব দোকানেও ক্রেতার দেখা নেই বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।

আরও পড়ুন

চাকচিক্য দমাতে পারেনি বাঁশ-বেতের কদর আসবাবে কাঠের স্থান দখল করছে প্লাস্টিক ফার্নিচার শিল্পের উন্নয়নে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে যৌতুকের ফার্নিচার ‘পুরোনো’, বিয়েতে এলো না বর!

বাড্ডা লিংক রোডের আলিশান ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী এনায়েত শিপু বলেন, ‘অন্যদিনের তুলনায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্রেতাদের ভিড় বেশি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা আসবাবপত্র দেখছেন। দরদাম করছেন কম। দাম জিজ্ঞেস করেই চলে যাচ্ছেন। পুরো রোজায় বিক্রি ভালো হয়নি।’

‘রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এবার বেচাকেনা ভালো নয়। অনেক দোকানেই কয়েকদিন ধরে কোনো বিক্রি নেই। যারা বহু বছর টাকা কামিয়েছে তারা যদি হঠাৎ গায়েব হয়ে যায় তখন তো বাজারে একটা শূন্যতা হয়। বিলাসী পণ্যেরও বেচাকেনা কমে।’ বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় মহাসচিব মো. ইলিয়াস সরকার

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও গোয়েন্দা সংস্থার ভয়ে অনেকেই আপাতত দামি আসবাবপত্র কিনছেন না।

তিনি বলেন, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর অনেকেই কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করছেন। বেশি টাকা খরচ করলে ওই টাকার উৎস নিয়ে খোঁজ-খবর শুরু হবে। এজন্য বড়লোকেরা টাকা-পয়সা খরচ করছে না।

বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় মহাসচিব ও ব্রাদার্স ফার্নিচারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ইলিয়াস সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এবার বেচাকেনা ভালো নয়। অনেক দোকানেই কয়েকদিন ধরে কোনো বিক্রি নেই। যারা বহু বছর টাকা কামিয়েছে তারা যদি হঠাৎ গায়েব হয়ে যায় তখন তো বাজারে একটা শূন্যতা হয়। বিলাসী পণ্যেরও বেচাকেনা কমে।’

এসএম/এমএমএআর/এমএস