সাহিত্য

সাইমা হাসানের গল্প: একাত্তরের বটতলী

সাইমা হাসানের গল্প: একাত্তরের বটতলী

১৯৭১ সাল। দেশজুড়ে স্বাধীনতার জন্য রক্ত ঝরছে। তেমনই এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বটতলী গ্রাম। নভেম্বরের হালকা শীতল বাতাসে গাছের পাতা দুলছে। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু দূর থেকে ভেসে আসছে গুলি আর গ্রেনেডের শব্দ।

Advertisement

ক্যাপ্টেন কামরুল ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর মধ্য দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে ভেঙে পড়লো এক বাড়ির পোড়া দেওয়ালের পাশে। বাম কাঁধে ও ডান পায়ে গুলি লেগেছে। রক্তে ভিজে গেছে ইউনিফর্ম। হাত দিয়ে কাঁধের ক্ষতস্থান চেপে ধরে রাখলেও রক্তক্ষরণ থামছে না। আশেপাশে কোনো শব্দ নেই, কোনো মানুষ নেই। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে ঝিঁঝি পোকার ডাক।

ব্যথা আর ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে তার। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে একটু আগের সেই ভয়াল মুহূর্ত। শত্রুপক্ষের গুলিবর্ষণে একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল তার সহযোদ্ধারা। বাঁচানোর চেষ্টা করেও কোনোভাবেই তাদের সরিয়ে আনতে পারেনি। তাদের শেষ চিৎকার, রক্তমাখা মুখ—সবই বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। বুকের ভেতরটা যেন চাপা পড়ে গেছে অপরাধ বোধে। কেন শুধু সে-ই বেঁচে আছে? ভাবতেই কামরুলের চোখের কোণায় জল জমে উঠলো।

হঠাৎ একটা মৃদু ফিসফিসানির শব্দ ভেসে এলো কানে। খেয়াল করে দেখে শব্দটা আসছিল উঠানের মাঝে দাঁড়ানো বটগাছটার পেছন থেকে। শব্দটা আবার শুনতে পেয়ে কামরুল তার ভাঙা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, ‘কে ওখানে? কেউ আছেন?’কোনো সাড়া না পেয়ে কামরুল আবারও ভয়ে ভয়ে বলে ওঠে, ‘কেউ কি নেই? থাকলে দয়াকরে সাড়া দেন।’

Advertisement

কিছুক্ষণ পর গাছের পেছন থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে এক মেয়ে। বয়স বেশি বলে মনে হলো না। তবে অন্ধকারে আন্দাজ করতে পারছে না। মেয়েটির শরীর ময়লা আর পোড়া ছাইয়ে মাখা। পরনে ছেঁড়া মলিন নীল শাড়ি। রুক্ষ লম্বা কালো চুল মুখ ঢেকে রেখেছে।

মেয়েটি মাথা তুলল। তার চোখে শূন্যতা। যেন কোনো জীবনের ছাপ নেই। ঠোঁট বেঁকে এক অসম্ভব হাসি ফুটে উঠল।‘ব্যাবাক লইয়া গেছে। মোর ব্যাবাক লইয়া গেছে।’ মেয়েটি ফিসফিস করে বলল। ‘মোর স্বামী... মোর গ্যাদা পোলা... ঘর... কিছু নাই মোর এহন।’

কামরুলের পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। সে কিছু বলতে পারল না। মেয়েটির গলা কাঁপছে। দুঃখে ভারী হয়ে উঠেছে। তবে তার কণ্ঠে আর একটি জিনিস কামরুল লক্ষ্য করে। তীব্র প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা।‘কে নিয়ে গেছে আপনার স্বামী আর বাচ্চা? তারা কোথায়?’ কামরুল জানতে চায়।এই প্রশ্নে মেয়েটির চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায়। ‘হোনতে চাছ কী হইছে মোর লগে? হেলে হোন!’

হঠাৎ চারদিকে ঘন কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ে। কামরুলের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন সে এখনই দম আটকে মারা যাবে। এমনিতেই গুলির ক্ষতের ব্যথায় সে আগে থেকেই ক্লান্ত। এখন এই পরিস্থিতি তার শরীর আর নিতে পারছিল না। এক পর্যায়ে সে কখন জ্ঞান হারালো, তা-ও সে জানে না।

Advertisement

আরও পড়ুনসাদিয়া হোসেন মাধুরীর গল্প: আয়নাপঙ্কজ শীলের গল্প: টিকটিকির রক্ত

জ্ঞান ফিরতেই কামরুল দেখে, সে আর ওই পোড়া দেওয়ালের পাশে নেই। সে দাঁড়িয়ে আছে উঠানের মাঝে। তাজ্জবের বিষয় হচ্ছে, সে যেখানে দাঁড়িয়ে; সেখানে কোনো পোড়া বাড়ির চিহ্ন নেই। এমনকি তার শরীরেও কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই। মনে হচ্ছিল সে থেকেও নেই ওখানে। কয়েক কদম হাঁটার পরই যে দৃশ্য সে দেখতে পায়, তার জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিল না।

যে মেয়েটিকে কামরুল বটগাছের পাশে দেখেছিল; ওই মেয়ে উঠানে কাপড় শুকাচ্ছিল। পাশে দুই বছরের একটা বাচ্চা খেলছে। কামরুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ একদল হানাদার বাহিনী উঠানে এসে হাজির। তাদের দেখেই মেয়েটির হাতের কাপড় মাটিতে পড়ে গেল। পাকিস্তানি এক সৈনিক এসে তার সামনে বন্দুক ঠেকিয়ে বলে, ‘মুক্তি কাহা হে?’‘হে মুই জানি না, সাহেব...’ মেয়েটি কম্পিত কণ্ঠে বলে।‘নেহি বলেগি হামে!’ সৈনিক মেয়েটির চুল ধরে এক হেঁচকা টান দেয়। মেয়েটি ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে।

এমন সময় বাইরের শোরগোল শুনে ঘরের ভেতর থেকে তার স্বামী বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বলে, ‘ওরে ছাইড়া দেন! ওর কোনো দোষ নাই!’‘আমনেরে কেডা বাইর হইতে কইছে? আমনে পালান!’ মেয়েটি চিৎকার করে তার স্বামীকে বলে।

পরক্ষণেই তার স্বামী ও তার দুই বছরের ছেলেটি মাটিতে লুটে পড়ে। গুলির শব্দে গাছের পাখিরা উড়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটিকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় ঘরে। সে বুঝতে পারে তার সাথে এখন কী হতে চলেছে। সে সৈনিকদের কব্জা থেকে কোনোমতে পালিয়ে চলে আসে রান্নাঘরে। চুলার পাশে থাকা কেরোসিনের বোতল নিয়ে নিজের গায়ে সব কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয় নিজ শরীরে। পাকিস্তানি জানোয়ারদের হাতে ইজ্জত হারানোর চাইতে সে বেছে নেয় মৃত্যুকে।

তারপর আবার সব অন্ধকার। কামরুল যখন আবার জ্ঞান ফিরে পেলো; সে নিজেকে তখন সেই পোড়া দেওয়ালের পেছনে বসা অবস্থায় পেলো। পুরো শরীর তার শীতল ঘামে ভেজা। ভাবতে লাগলো এতক্ষণ কি সে স্বপ্ন দেখছিল? তাহলে বটগাছের ওখানে থাকা মেয়েটি কোথায়? হঠাৎ সে লক্ষ্য করলো, তার গুলির জখমগুলো ঠিক হয়ে গেছে। যেন সে কখনো গুলিতে আহত হয়নি। তবে ইউনিফর্মে ছিল রক্তের দাগ। কামরুলের নিঃশ্বাস যেন বুকে আটকে গেল। তাহলে কি সে যা এতক্ষণ দেখছিল তা সত্যি? হঠাৎ সে আবারও সেই একই ফিসফিস শব্দ শুনতে পেলো, ‘এই দেশ মুক্তি না পাইলে মুইও কোনোদিন মুক্তি পামু না। তোর নাহান মানুরাই পারবো এই দেশ মুক্ত করতে। যা, মাইরা হালা ওই জানোয়ারগো। নে মোর প্রতিশোধ।’

ধীরে ধীরে ফিসফিস শব্দটি মিলিয়ে গেল। কামরুল নিঃশ্বাস ফেলে দেওয়ালে হেলান দিয়ে পড়লো। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।

সে ধীরে ধীরে দাঁড়ালো। পায়ে সমস্ত জোর দিয়ে এগিয়ে চললো। তার হাতে অস্ত্র নেই কিন্তু যুদ্ধ করার জন্য বুকের মাঝে নতুন উদ্দীপনা পেয়েছে। যুদ্ধ শেষেও বেঁচে থাকার শক্তি চাই—আর সেই শক্তি এখন তার কাছে নতুন রূপে এসেছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, অনার্স ৩য় বর্ষ, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।

এসইউ/জেআইএম