প্রবাস

নোবেল পুরস্কার জয়ী এক ব্যক্তিত্বের সোনালি অর্জন ও অনুপ্রেরণা

নোবেল পুরস্কার জয়ী এক ব্যক্তিত্বের সোনালি অর্জন ও অনুপ্রেরণা

অনেক দূরের এক দেশে, যেখানে মানুষ স্বপ্ন দেখে, কিন্তু বাস্তবতা তাদের স্বপ্নকে বারবার গলা টিপে ধরে। সেখানে জন্ম নিলো এক শিশু, যার চোখে ছিল সমুদ্রের গভীরতা আর মন ছিল আকাশের মতো বিস্তৃত। তার নাম ছিল ‘নুরান’—অর্থাৎ, যিনি আলো ছড়ান।

Advertisement

নুরান বড় হলো এমন এক সমাজে, যেখানে ধনী আরও ধনী হয়, আর গরিবেরা দিন গোনে কখন ভাতের থালায় ভাত উঠবে। কিন্তু সে থেমে থাকলো না। তার মনে হলো, ‘যদি আলো এক জায়গায় থাকে, তবে অন্ধকার কখনোই দূর হবে না। আলো ছড়িয়ে দিতে হবে।’

সে জানতো, সে একা কিছু করতে পারবে না, তবে যদি একে একে হাজারো মানুষ একে অপরকে সাহায্য করতে শুরু করে, তবে সে সমাজ বদলে যেতে পারে। নুরান একদিন এমন এক সোনার মুদ্রা তৈরি করলো, যা ছিল জাদুর মুদ্রা। এই মুদ্রার শক্তি ছিল এমন—যদি এটি একজন গরিব মানুষের হাতে পড়ে, তবে তা তার জীবনের পরিবর্তন আনতে সাহায্য করবে। তবে, শর্ত ছিল একটাই—যদি সে এই সাহায্য নিয়ে অন্য কাউকে সাহায্য না করে, তবে মুদ্রাটি তার কাছে মূল্যহীন হয়ে যাবে।

ধীরে ধীরে, এই মুদ্রার জাদু ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। একে একে শত শত, হাজার হাজার মানুষ নিজেদের ভাগ্য বদলাতে থাকল, কিন্তু তারা সবাই আরও কাউকে সাহায্য করতে থাকল। ফলস্বরূপ, সমাজের চেহারাই বদলে গেলো। একে অপরকে সাহায্য করার এই প্রক্রিয়া ক্রমেই একটি আন্দোলনে পরিণত হলো, যার শেকড় গেড়ে নিলো মানবতার আদর্শ।

Advertisement

এই খবর ছড়িয়ে পড়লো রাজ্যের বাইরে, মহাদেশের বাইরে, গোটা বিশ্বে। বড় বড় রাজারা নুরানের এই জাদুর মুদ্রার রহস্য জানতে চাইল, কিন্তু সে শুধু বললো, ‘এটি কোনো জাদু নয়, এটি শুধু বিশ্বাসের শক্তি।’

একদিন, নুরানের সম্মানে এক বিশাল স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করা হলো, যা শুধু তার অর্জনকেই নয়, বরং পুরো বিশ্বের জন্য এক অনুপ্রেরণা হিসেবে রইলো। আর সেই মুদ্রার একপাশে লেখা রইল—‘আলো একা নয়, আলো ছড়াতে জানলে তবেই তা সত্যিকারের আলো।’

এই রূপকথা কোনো কল্পকাহিনি নয়, এটি আমাদের সময়ের এক সত্য গল্পের প্রতিচ্ছবি। এটির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে আমাদের সমাজের বর্তমান চিত্রের। এটি একটি মূর্ত প্রতীক—একটি আদর্শ, যা বিশ্বকে দেখাচ্ছে যে, শুধু প্রতিটি ব্যক্তি নিজের উন্নতি নয় বরং ঐক্যবদ্ধভাবে মানবতার কল্যাণে কাজ করলেই আসবে পরিবর্তন।

ঠিক সেই সোনার মুদ্রার মতোই, মানবতার ইতিহাসে খোদাই করে রাখা হয়েছে এক বিশেষ স্বর্ণমুদ্রা—যার গায়ে জ্বলজ্বল করছে আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতি। এটি কেবল ধাতুর নয়, এটি একটি আদর্শের প্রতীক, একটি পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি।

Advertisement

আর এই বিজয়ের মুদ্রাটি অর্জন করেছেন আমাদেরই একজন, যিনি অর্থনীতিকে কেবল সংখ্যার খেলা হিসেবে দেখেননি বরং সেটিকে ব্যবহার করেছেন মানবতার কল্যাণে, দারিদ্র্যমোচনের এক অনন্য হাতিয়ার হিসেবে। তিনি কেবল একজন ব্যক্তি নন, বরং একটি নতুন যুগের স্থপতি, যার দর্শন বিশ্বকে দেখিয়েছে ‘সম্ভাবনার অর্থনীতি’—একটি এমন কাঠামো যেখানে অর্থ কেবল শক্তি নয় বরং মুক্তির পথ।

এই অর্জন শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি এক বৈশ্বিক আন্দোলনের সূচনা, যা হতে পারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার প্রথম পদক্ষেপ। একটি মানবিক সমাজ, একটি সত্যিকারের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য যে সংগ্রাম, তার মশাল হাতে তুলে নিয়েছেন তিনি।

বলছি নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা—যিনি অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়েছেন মানবকল্যাণের পক্ষে, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে এবং পেয়েছেন শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার।

আমরা পেয়েছি তাকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর হতভাগ্য মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর এক অগ্রদূত হিসেবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমরা কী সত্যিই তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই লড়াইয়ে শতভাগ নিষ্ঠা নিয়ে এগিয়ে চলেছি? নাকি আমরা নিজেরাই বাধা ও কাঁটা হয়ে সেই চলার পথকে আরও কঠিন করে তুলছি?

তিনি দেখিয়েছেন যে দারিদ্র্য কোনো অভিশাপ নয় বরং এটি একটি অব্যবস্থাপনার ফল। তিনি দেখিয়েছেন, অর্থনীতির সঠিক ব্যবহারে সমাজের প্রান্তিক মানুষও নিজের ভাগ্য গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু আমরা কী তার সেই শিক্ষাকে গ্রহণ করছি? নাকি সংকীর্ণ স্বার্থ আর বিভক্তির রাজনীতির ফাঁদে পড়ে সেই পরিবর্তনের গতিকে রুদ্ধ করে দিচ্ছি?

এই অর্জন কেবল একজন মানুষের নয়, এটি আমাদের সবার। এটি শুধু সম্মানের নয়, এটি দায়িত্বেরও। এখন সময় এসেছে আত্মজিজ্ঞাসার—আমরা কি সত্যিই ন্যায়ের পক্ষে? নাকি অজান্তেই অবিচারের শিকলে নিজেদের বন্দি করে ফেলেছি?— জাগো বাংলাদেশ, জাগো!

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)Rahman.Mridha@gmail.com

এমআরএম/এমএস