দুদিন আগেও সাজানো সংসার ছিল তাদের। সারি সারি ঘরগুলোতে আসবাবপত্র, গহনা, চাল, ডাল ও ফসলাদিতে ছিল ভরপুর। গোয়াল ঘরে বাঁধা ছিল বড় বড় গরু। এসব এখন শুধুই স্মৃতি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সর্বনাশা আগুন তাদের সবকিছু পুড়িয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছে। এখন তারা সর্বস্বান্ত।
Advertisement
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার যদুবয়রা ইউনিয়নের বরইচারা গ্রামের সাত পরিবারের গল্প এটি। বুধবার (১৯ মার্চ) দুপুরে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে প্রথমে আগুন লাগে ওই গ্রামের মোকাদ্দেস হোসেনের ছেলে আব্দুল্লাহর গোয়ালঘরে। এরপর মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের সাতটি বাড়িতে। এসময় নিজ ঘরে থাকা মাত্র ৩০০ টাকা উদ্ধার করতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে প্রাণ যায় সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ মোকাদ্দেস হোসেনের।
এছাড়া গোয়ালঘর থেকে প্রায় আড়াই লাখ টাকা মূল্যের দুটি গরু উদ্ধার করতে গিয়ে প্রায় ৬০ ভাগ দগ্ধ শরীর নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তার পুত্রবধূ নাজমা খাতুন।
শুক্রবার (২১ মার্চ) সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বরইচারা - আমতলা গ্রামীণ সড়ক ঘেঁসে আব্দুল্লাহদের বাস। বাতাসে পোড়া গন্ধ। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে টিনশেডের ঘর, আসবাবপত্র, গহনা, চাল, ডাল, গরুসহ সবকিছু। অবশিষ্ট আছে শুধু ঘরের খুঁটি আর পরনের কাপড়। কেউ ছাই অপসারণ করছেন। খোলা আকাশের নিচে টাঙানো কাপড়ের নিচে বসে আছেন কেউ কেউ। প্রতিবেশীরা চাল, ডালসহ জীবনধারণের জন্য বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন কেউ-কেউ।
Advertisement
এসময় বিলাপ করে নিহত মোকাদ্দেস হোসেনের স্ত্রী আছিয়া খাতুন (৬৫) বলেন, ‘ঘরে ৩০০ টাহা ছিল। আগুন ধরলি সোয়ামি টাহা আনতে গিয়ে পুড়ে গিছিল। সগ্গলে ধরে হসপিটালে নিছিলো। তাও বাঁচে ফিরল না। ৩০০ টাহার শোগে মরেছে গো। আহারে। বেটার বউ এহনও হসপিটালে পাঞ্জা লড়ছে।’
ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘আমার ঘরও গেল, মানুষও গেল। এহন আর কি করুম। মানষে সামিয়ানা টাঙায় দিছে, চাল ডাল দিচ্ছে। একগাল কোনোমতে খাচ্ছি।’
আছিয়ার ছেলে মো. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সবাই দিনমজুর। খেটেখুটে যা করিছিলাম। সবই শ্যাষ। বাকি আছে শুধু ঘরের খুঁটি। নতুন ঘর করার সামর্থ্য নেই। খোলা আকাশের নিচে সারারাত শুয়ে বসে কাটাচ্ছি।’ তার ভাষ্য, সকলের সহযোগিতা ছাড়া জীবনে ফের ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।
সেদিন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন দেখে ছুটে আসেন প্রতিবেশীরা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেন কুমারখালী ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিটের সদস্যরা। সবার প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণ এলেও মোকাদ্দেস হোসেন, তার ছেলে আব্দুল্লাহ, আব্দুল্লাহর ছেলে রাজিব হোসেন, মৃত হাসমতের ছেলে কেরামত আলী ও আবু দাউদসহ অন্তত সাতজন দিনমজুরের টিনশেডের ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, গহনা, ধান, চাল, ফসলাদি ও দুইটি গরু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বর্তমানে তারা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
Advertisement
তাদের দাবি, বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগে প্রায় ২৫-৩০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত রাজিবের স্ত্রী মাছুরা খাতুন বলেন, ‘কিচ্ছু নেই। লোকজন যা দিচ্ছে। তা খেয়ে পড়ে তাঁবু টাঙিয়ে থেকে রোজা করছি। আপনারা একটু সাহায্য করুন।’
প্রতিবেশীরা বলছেন, যা কিছু ছিল গচ্ছিত। সবই পুড়ে গেছে আগুনে। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর আর কোনো অবলম্বন নেই। সকলের সহযোগিতা পেলে আবার ঘুরে দাঁড়াবেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে তিন হাজার টাকা এবং নিহতের পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা প্রাথমিকভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে। লিখিত আবেদন পেলে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পরবর্তীতে আরও বড় আকারে সহযোগিতা করা হবে।
আল-মামুন সাগর/এমএন/এমএস