ঈদকে সামনের রেখে পাবনার বিপণিবিতানগুলো ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখরিত থাকলেও উল্টো চিত্র লুঙ্গি দোকানগুলোতে। ঈদের মাত্র দেড় সপ্তাহ বাকি থাকলেও তেমন বেচাকেনা নেই বলে জানান বিক্রেতারা। দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পোশাকে আধুনিকতা ও জাকাতের ধরণ পরিবর্তনের কারণে ক্রেতার সংকট বলেন দাবি তাদের।
Advertisement
জেলার পুরোনো লুঙ্গির দোকানগুলোর বেশিরভাগেই বড় বাজার এলাকার বেনিয়া পট্টির ব্যাংক রোডে। এখানে প্রায় ১৫ থেকে ২০টি দোকান রয়েছে। এখানকারই একটি পুরোনো প্রাচীন লুঙ্গির দোকান আরমান লুঙ্গি হাউজ। দীর্ঘ ৩৫ বছরের ব্যবসা তাদের। এ দোকানে ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১৪৫০ টাকা দামের লুঙ্গি রয়েছে। তবে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা দামের চাচকিয়া লুঙ্গি বেশি বিক্রি করছেন এ দোকানি।
দোকানির দাবি, আর্থিক মন্দা, পোশাক পরিধানের অভ্যাস পরিবর্তন ও জাকাতের ধরন পরিবর্তনের ফলে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ঈদে বেচাকেনার বেহাল দশা।
দোকানের স্বত্বাধিকারী আজিম উদ্দিন জানান, সাধারণ সময়ে প্রতিদিন সাত থেকে আট হাজার টাকার লুঙ্গি বিক্রি হয়। এ বছরের ঈদের বাজারে প্রতিদিন এখন বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ একদিন ১৮ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে। অথচ লুঙ্গির ভালো দিনে বা অন্তত ৫ থেকে ১০ বছর আগেও ঈদের সামনে প্রতিদিন লাখ টাকার বেশিও লুঙ্গি বিক্রি হয়েছে। গত কয়েক বছর ধীরে ধীরে ঈদে লুঙ্গি বিক্রি কমতে শুরু করেছে। তবে গত বছর ঈদের বাজারেও ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে। এগুলো এখন শুধু অতীত।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, আগে বড় বড় ঠিকাদার ও রাজনৈতিক নেতারা লুঙ্গি বেশি দান করতেন। কিন্তু তারা এখন পলাতক। অন্যান্য যারা আছেন তারা টুকটাক নিচ্ছেন। এছাড়া জাকাতের টাকায় শাড়ি লুঙ্গি দিতেন বিত্তশালীরা। মানুষের চাহিদা বিবেচনায় যাকাতের ধরন পাল্টেছে। তারা এখন নগদ টাকা জাকাত হিসেবে দান করেন। সবকিছু মিলিয়ে বেচাকেনার বেহাল দশা। ৩৫ বছরের ব্যবসায় এতো খারাপ অবস্থা যায়নি বলেও জানান তিনি।
সরেজমিনে পাবনার লুঙ্গি দোকানগুলোতে দেখা যায়, প্রতিটি দোকানের সামনে প্লাস্টিক বা কাঠের টুল পেতে ক্রেতার আশায় বসে রয়েছেন বিক্রয়কর্মীরা। এই পট্টিতে কেউ ঢুকলেই দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তারা। তবে তেমন ক্রেতার সাড়া মিলছে না। দু-চারজন যারা এসেছেন, নিজে পরার জন্য সর্বোচ্চ দুটি ও যাকাতের জন্য ৫-৭টির বেশি কিনছেন না।
নুরানী লুঙ্গি হাউজের আলী হাসান বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় ঈদে বেচাবিক্রি তিন ভাগের এক ভাগ। গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। এই সময়ে কথা বলার সুযোগই থাকার কথা না, অথচ বসে আছি। তবে দু-চারদিন পর বেচাকেনা একটু বাড়তে পারে বলে ধারণা করছি। সেই আশাতেই আছি।
পাবনার লুঙ্গি পট্টির আরেকটি প্রাচীন লুঙ্গির দোকান আরাফ লুঙ্গির ঘর। এ দোকানের আহসানুল্লাহ মুন্সী জানান, সবচেয়ে পুরোনো লুঙ্গির দোকান এটি। চাচকিয়া লুঙ্গির জন্য পাবনায় এ দোকানের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। বাপ দাদারা এই ব্যবসা করেছেন। তিনিও এই প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে হাল ধরেছেন লুঙ্গি ব্যবসার। তবে ব্যবসায় যে মন্দা যাচ্ছে তাতে এটি কতদিন ধরে রাখতে পারবেন সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, এখন ঈদের বিক্রির সবচেয়ে ভালো সময়। এখনই যাকাত ফিতরা প্রদানকারীরা শাড়ি লুঙ্গি কিনে অসহায়দের দেবেন। কিন্তু বিক্রির যে হাল তা নিয়ে কিছু বলার নেই। ক্রেতা ও বিক্রেতারা বলছেন, সময় পাল্টেছে। এখন ট্রাউজার আর হাফ প্যান্টে অবসর সময় কাটান অধিকাংশরা। যে কারণে কারণে লুঙ্গির চাহিদা কম। দিন যাচ্ছে লুঙ্গি ও তাঁতশিল্পজাত পণ্যের দুর্দিন আরো জেঁকে বসছে। এভাবে চললে বাপ দাদার ব্যবসা কয়দিন চালাতে পারবো তা বলা মুশকিল।
ব্যবসায়ীরা বলেন, লুঙ্গির চেয়ে খাবার ও অন্যান্য সামগ্রীর চাহিদা মেটানোই দায় হয়ে পড়েছে মানুষের। জাকাতের ধরনও পাল্টেছে। শাড়ি লুঙ্গির বদলে এখন নগদ টাকাই বেশি দান করছেন বিত্তবানরা। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনও নগদ টাকা প্রদান করছেন। কারণ অসহায়রা নগদ টাকাতেই অধিক খুশি। সবমিলিয়ে লুঙ্গি বাজারে ঈদ নেই।
লুঙ্গি কিনতে আসা শামীম আহমেদ জুয়েল বলেন, আগের মতো লুঙ্গি পরা হয় না। বেসরকারি চাকরিতে ডিউটির শেষ নেই। যেটুকু সময় অবসর যায় এতে দুয়েকটা লুঙ্গি থাকলে চলে। পরা কম হয় জন্য নষ্টও কম হয়। এজন্য খুব বেশি কেনাও হয় না। অনেকদিন পর পরার জন্য দুটি লুঙ্গি নিতে এলাম।
বেসরকারি কলেজের শিক্ষক মোনায়েম আলী খান। স্ত্রী নিয়ে জাকাতের লুঙ্গি কিনতে এসেছেন। তিনি বলেন, সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিবছরই যাকাত দেই। পূর্বে জাকাত বলতে শাড়ি লুঙ্গিই ছিল। এজন্য সেসময় বেশ সংখ্যক শাড়ি ও লুঙ্গি কেনা হতো। কিন্তু এখন ততোটা নেই। যারা জাকাত নেবেন তাদের অধিকাংশই আগে এসে অনুরোধ করেন নগদ টাকা দিতে। শাড়ি লুঙ্গির চেয়ে নগদ টাকা নাকি তাদের বেশি কাজে আসে। তাই এবছর ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দামের মধ্যে পাঁচটা লুঙ্গি ও সাতটি শাড়ি নেবো। বাকিদের নগদ টাকা দিতে হবে।
তাঁতশিল্প তথা লুঙ্গি বুননে পাবনার ঐতিহ্য পুরোনো। জেলার সদর উপজেলার দোগাছি ও আটঘরিয়ার চাচকিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলার খলিয়া, লক্ষ্মীপুর, গোপালপুর, সুজানগর, সাদুল্লাহপুর ও রাজাপুর নতুনপাড়ায় বুনন করা হয় ঐতিহ্যবাহী লুঙ্গি। ২৫০ থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা মূল্যের লুঙ্গি পাওয়া যায় এখানে। তবে এবার পাবনার বাজারগুলোতে বেশি চাহিদা দোগাছির দোতার লুঙ্গির। খুচরা বাজারে এর দাম ৪৫০ টাকা। এরপরই রয়েছে দেশখ্যাত চাচকিয়া লুঙ্গির চাহিদা। এর বাইরে বিত্তবানদের জন্য সাড়ে চার হাজার টাকা দামের ডিসেন্ট ও প্রায় চার হাজার টাকার ক্রিসেন্ট লুঙ্গিও রয়েছে দোকানগুলোতে।
আলমগীর হোসাইন/এমএন/এমএস