ফিচার

বার্ধক্যে শরীরে রোগব্যাধি বাসা বাঁধলে সুখস্মৃতিও অসহ্য লাগে

পুরান ঢাকায় ঢাকা জেলা প্রশাসকের কক্ষের বাইরে ওয়েটিং রুমে মঙ্গলবার দুপুরে বসে ছিলেন কয়েকজন সাক্ষাৎপ্রার্থী। তাদের অধিকাংশই তরুণ। দু’চারজন মধ্যবয়সী ও একজন বৃদ্ধাও ছিলেন। কম-বেশি সবাই-ই ঘুরে-ফিরে বৃদ্ধাকেই দেখছিলেন।  আনুমানিক সত্তর-পঁচাত্তর বছর বয়সী ধবধবে সাদা চুলের বৃদ্ধার পরণে সাধারণ একটি সুতির শাড়ি।  চোখে চশমা। কাঁধে কালো রংয়ের একটি ব্যাগ। এক হাতে একটি ফাইল ধরে বসে আছেন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের ব্যক্তিগত সহকারীর কাছে সাক্ষাৎপ্রার্থী হিসেবে নাম লিখিয়ে জানতে চাইছিলেন কখন তার দেখা পাবেন। বৃদ্ধাকে জানানো হলো, স্যার একটু আগেই ফিরেছেন, নামাজ পড়বেন, খাওয়া-দাওয়া করবেন, কিছু দাফতরিক কাজ করবেন। তবে তিনি সবার সঙ্গে দেখা করবেন। উপস্থিত সকলের সঙ্গেই এক বা একাধিক সঙ্গী থাকায় তারা আলাপে মশগুল। কিন্তু বৃদ্ধা একা হওয়ায় কিছুক্ষণ পর পর চোখের চশমা খুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছছিলেন আর ফাইল খুলে কাগজপত্র দেখাদেখি করছিলেন। বৃদ্ধার উপস্থিতি কেন তা জানতে সালাম দিয়ে তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করলে প্রথমে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেও পরে জানালেন, ৫০ বছরেরও বেশি সময় তিনি পুরান ঢাকার ২০ নং সতীশ সরকার রোডের একটি বাড়িতে বাস করছেন।পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া বাড়িটির ভূমি উন্নয়ন কর ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত পরিশোধ করে আসলেও পরবর্তীতে তার কাছ থেকে আর কর নেয়া হচ্ছে না। তার বাড়িসহ ওই এলাকার বাড়িগুলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকৃত খাস মহল জমি। কিন্তু তার কাছে সব ধরনের কাগজপত্র রয়েছে।  গত আটমাস ধরে বিষয়টি সুরাহার জন্য জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ঘোরাফেরা করলেও সমাধান পাননি। তাই জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। বৃদ্ধা বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে অথচ আট মাস পেরিয়ে গেলেও আবেদনটির চেহারাও হয়তো জেলা প্রশাসক দেখেননি। কথাবার্তায় চটপটে এ বৃদ্ধা কেন এই বয়সে জেলা প্রশাসকের বারান্দায়, পেশা কী ছিল ইত্যাদি জানতে চাইলে তিনি জানান, তার একটা মাত্র ছেলে, ব্যবসা করে। জমিজমার বিষয়ে তার খুবই অনাগ্রহ। এ কারণে, তিনি নিজেই দৌড়ঝাঁপ করছেন। তবে পেশা কী ছিল তা জেনে কী লাভ, সে দিনতো পেরিয়ে এসেছেন, পুরোনো কাসুন্দি ঘেটে লাভ নেই ইত্যাদি বলে এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন তিনি। হঠাৎ দেখা গেল ফাইলের একটি কপিতে লেখা ডা. শেলিমা খানম। বয়স ৭২ বছর। আপনি চিকিৎসক ছিলেন- জিজ্ঞাসা করতেই একগাল হেসে বলেন, এই আপনারা সাংবাদিকরা পারেনও। শেষ পর্যন্ত পরিচয় বের করে ফেললেন। এবার তিনি জানালেন, ১৯৬৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) এমবিবিএস ভর্তি হয়ে ১৯৭৪ সালে পাস করেন তিনি। চাকরি পেতে কোনো কষ্টই করতে হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে বহুবছর চাকরি করে বছর দশেক আগে সহকারী পরিচালক হিসেবে অবসর নিয়েছেন। কেমন ছিল পুরান ঢাকা- এ প্রশ্ন করতেই তিনি কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, আগে তো পুরান ঢাকাই ছিল মিনিস্টার, সাংসদসহ অভিজাতদের এলাকা। এখন কালের বির্বতনে নতুন ঢাকা হয়েছে। তিনি জানালেন, এখানকার বাড়িগুলোকে ছোট বাড়ি, বড় বাড়ি ইত্যাদি নামে ডাকা হতো। সবাই সবাইকে চিনতেন। সদরঘাট থেকে গুলিস্তান যাওয়ার একমাত্র রাস্তা ছিল নবাবপুর রোড। পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে কি না, ভাল লাগে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে শেলিমা খানম বলেন, বৃদ্ধ বয়সে শরীরে নানা রোগব্যাধি ভর করে। তাই সুখস্মৃতিগুলো তখন ভাল লাগে না, অসহ্য মনে হয়। কথায় কথায় জেলা প্রশাসকের কক্ষ থেকে ডাক আসে বৃদ্ধার। সাক্ষাৎ শেষে ফিরে যাওয়ার সময় তার চেহারায় কিছু স্বস্তির ছাপ দেখা যায়। জেলা প্রশাসক কী বললেন, জিজ্ঞাসা করতে বৃদ্ধার জবাব, ভালো ব্যবহার করে বললেন, কষ্ট করে এসেছেন। আর আপনার আসতে হবে না। দুই সপ্তাহ পর তিনি নিজে ফোন করবেন। তিনি বললেন, মুখের কথায় আশ্বস্ত হতে পারেননি। বৃক্ষ তোমার নাম কী ফলে পরিচয়। দুই সপ্তাহ পর এর প্রমাণ পাবেন বলেই হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন ৭২ বছর বয়সী ডা. শেলিমা খানম।এমইউ/এনএফ/পিআর

Advertisement