মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারি পর্যায়ে এবং সমাজে প্রচুর উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বস্তুত, সরকারের প্রথম টার্গেট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা । এটাই স্বাভাবিক কারণ এর ধকল সবচেয়ে বেশি বহন করে গরিব শ্রেণি যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। মুখরা রমণীকে বশ করতে না পারলেও সংসার কোনোভাবে টিকে থাকে, কিন্তু লাগামহীন মূল্যস্ফীতি বশে আনতে না পারলে সমাজের সমূহ খতির সম্ভাবনা থাকে - ঊর্ধ্বগামী মূল্যস্ফীতি রাজনৈতিক ডিনামাইটে রূপ নিতে পারে। ইতিমধ্যে খানার আয় এবং ব্যয় সমীক্ষা (২০২২) জানাচ্ছে যে, আয় বৈষম্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে- যেমন গিনি সহগ নব্বই দশকের শূন্য দশমিক তিন পাঁচ থেকে ২০১০ সালে শূন্য দশমিক চার পাঁচ এবং ২০২২ সালে শূন্য দশমিক চার নয়) এবং মূল্যস্ফীতি , যা গরিবের উপর রিগ্রেসিভ ট্যাক্সের মতো , সেই বৈষম্যে জ্বালানি দিয়ে পরিস্থিতি নাজুক করে তুলছে । তবে দারিদ্র্য এবং বৈষম্য এই দুই সংকটের মধ্যে দারিদ্র্য হ্রাসের ইতিবাচক সংবাদে বাঁচোয়া বাংলাদেশ।
Advertisement
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জায়েদি সাত্তার মনে করেন যে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সমস্যার প্রকৃতি ও উৎস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া । প্রায়শ উপেক্ষিত এমন একটি দিক হচ্ছে মূল্যস্ফীতির উপর বিনিময় হারের সঞ্চারণ বা ‘পাস -থ্রু প্রভাব’, এটা কমাতে মানসম্মত অস্ত্র, লক্ষ্যমাত্রা এবং পৌঁছার সময়সীমা ইত্যাদি। আইএমএফ এক অসুখকর অনুভবের দিকে ঠেলে দেয় যখন প্রতিষ্ঠানটি মনে করে যে, ‘অপ্রত্যাশিত সহায়ক অভিঘাত’ না পেলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কয়েক মাস থেকে দুই বছরও লেগে যেতে পারে । এই দীর্ঘ বেদনাদায়ক প্রতীক্ষায় না থেকে গবেষক জায়েদি সাত্তার একটা ‘অপ্রত্যাশিত সহায়ক অভিঘাত’ দেবার কথা বলছেন।
প্রথমত, শুল্ক কাঠামো যৌক্তিক করার সময় এসেছে এবং সেটা শুধু সমকক্ষদের সাথে সমতুল্য করার জন্য নয় বরং আমাদের রফতানিকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করা এবং সংরক্ষণে রফতানি -বৈরিতা পরিহার করার জন্য যা দীর্ঘকাল আমাদের রফতানি বৈচিত্র্য করনে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করছে। শুল্কের হার কমানো বা যৌক্তিক করার ক্ষেত্রে একগুঁয়ে প্রতিরোধের পেছনে কারণ রাজস্ব হারানো (আহরণের বিপরীতে ) এবং তথাকথিত ‘শিশুশিল্প’ যুক্তি যে এগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে বেড়ে উঠার জন্য।
২০২২ সালে একই সময়ে ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনা বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়- রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিপর্যস্ত সাপ্লাই চেইন যার ফলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, বিশেষ করে খাদ্য, জ্বালানি এবং সারের) এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার তির্যক অবমূল্যায়ন যা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর অবধি ৩০ শতাংশের মতো । আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কিছুটা হ্রাস পেলেও এই দুই উৎসের দ্বিতীয় পর্বের প্রভাব অনুভূত হতে থাকলো । ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সরকার কর্তৃক জ্বালানির দাম ৫০ ভাগ বৃদ্ধি করেও লাভ হল না। মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের নিচে থাকলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের উপর চড়তে লাগলো ।
Advertisement
এটা এখন পরিষ্কার যে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি প্রধানত ব্যয় বৃদ্ধি- তাড়িত (cost-push) । বিপর্যস্ত সাপ্লাই চেইন এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন একটা সরবরাহ ধাক্কা নিয়ে আসে (supply shock) যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয় এবং গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো অর্থ সম্প্রসারণ দ্বারা পুষ্ট হয়। অবশ্য দ্বিতীয়টি প্রচলিত পদ্ধতি /সুপারিশ যথা আর্থিক সংকোচন এবং সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক উল্টাতে সক্ষম হয়েছে। তার সাথে যুক্ত আছে জুলাই ২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারি ঋণ (মূলত টাকা ছেপে নিরেট মূল্যস্ফীতি মুখি পদক্ষেপ) নেবার তাগিদ স্থগিতকরণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে একটা নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি প্রত্যাশিত যা রাজস্ব ঘাটতি মানিতাইজেসন সীমিত রাখবে।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সনাতন সংকোচন নীতি হয়তো চাহিদা সংকোচনে ভূমিকা রাখবে কিন্তু আমদানির মূল্য বৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়ন সঞ্জাত সরবরাহ অভিঘাত মোকাবেলায় উপযুক্ত নয়। . বস্তুত, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক আরোপিত প্রকট আমদানি সংকোচনের ফলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে (স্বল্পতার সুযোগে) এবং এভাবেই সময়ের বিবর্তনে কষ্ট -পুশ ইনফ্লেশনে অতিরিক্ত একটা উপাদান হিসাবে যোগ হয়। মূল্যস্ফীতির একটা বিশেষ চালকের দিকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে মনোযোগ দেয়া জরুরি এবং সেটা হল বিনিময় হারে ব্যাপক অবমূল্যায়ন। সামস্তিক অর্থনীতিক স্থিতিশীলতার গাড়িটি উল্টে বা উবুড় করে দিয়েছে এমন ঘটনা কারও স্মৃতিতে জাগে বলে তো মনে হয় না।
আর তাই উদীয়মান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিনিময় হার কীভাবে মূল্যস্ফীতি সঞ্চারিত করে (pass through) সে সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় । এমন পাস -থ্রুর মাত্রা এবং পর্যাবৃত্ত মূলত নির্ভর করে অর্থনীতিক পরিবেশের উপর যেমন, (ক) বিনিময় হারের কতটুকু নমনীয়, (খ) আমদানি-ভেদন ( ইম্পরট পেনেটরেসন ) ,এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে আমদানির অংশ, (গ) অভ্যন্তরীণ বাজার প্রতিযোগী না একচেটিয়া কাঠামো, (ঘ) বিদ্যমান বাণিজ্য অবমুক্তি, এবং বাজারে সরকারি হস্তক্ষেপ।
দেখা গেছে যে, সঞ্চারণ বা পাস থ্রু ছিল প্রায় সমকালীন এবং তাৎপর্যপূর্ণ । বিপুল অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন মূল্যস্ফীতিকে ধরে রাখে যেহেতু একে মোকাবেলা করার জন্য সমকালীন ক্ষতিপূরণমূলক বিপরীত পদক্ষেপ দৃশ্যমান ছিল না, এমনকি আলোচনায়ও স্থান পায় নি। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হতে পারে , বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কতটুকু সঞ্চারণের কারণে? গবেষক জায়েদি সাত্তারের মতে, মে ২০০২ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৩ অবধি ডলারের বিপরীতে টাকার মান হ্রাস পায় প্রায় ৩০ শতাংশ ।
Advertisement
তাত্ত্বিক দিক থেকে বাংলাদেশ আমদানি বাজারে খুব ক্ষুদ্র খেলোয়াড় বলে সে দাম প্রভাবিত করতে পারে না। অর্থাৎ দেশটি দেয় দামে বাণিজ্য করে (প্রাইস টেকার ) এবং তার আমদানি চাহিদা রেখা অনুভূমিক। সুতরাং অভ্যন্তরীণ দাম আমদানি দামের প্রতিফলন ঘটায় (টাকায় দাম + শুল্ক , যদি থাকে )। এর ফলে আমদানি দাম বৃদ্ধি পেলে ( অবমূল্যায়নের ফলে মূল্য বৃদ্ধি সহ) অভ্যন্তরীণ বাজারে ওয়ান টু ওয়ান দাম বৃদ্ধি পায়। আই এম এফ এক হিসাবে বলছে বাংলাদেশে যদি মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ হয়, তা হলে সরাসরি কিংবা ঘুরিয়ে পাঁচ শতাংশ বা অর্ধেক আসে মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে । যদি তাই হয় তাহলে আই এম এফ সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিদুমান উঁচু শুল্ক (মোট কর আদায়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ) নিয়ে এতটা নীরব কেন?
অবশ্যই অধিক রাজস্ব আহরণ আমাদের কাম্য এবং তা কীভাবে করা যায় সে বিষয়ে বিস্তর লেখালেখি আছে। কিন্তু উদোর পিণ্ডি বুধোর কাঁধে দিয়ে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করে রাজস্ব আদায় সবচেয়ে ভালো পন্থা নয়। আমরা অবগত আছি যে শুল্ক যৌক্তিক না করার বা শুল্ক হ্রাসের ক্ষেত্রে যে একগুঁয়ে মনোভাব কাজ করে মূলত দুটো কারণে ঃ রাজস্ব বৃদ্ধি এবং স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেয়া। তবে এখন সুবর্ণ সুযোগ এসেছে সঞ্চারিত মূল্যস্ফীতি কমাতে শুল্কের হার কমিয়ে দেয়া অর্থাৎ সঞ্চারণের ফলে যে ক্ষতি হয় তা পুষিয়ে নেয়া (Compensated depreciation)।
এভাবেই না রাজস্ব আহরণ , না শিশুশিল্প সুরক্ষার যুক্তি ধোপে টেকে । তাছাড়া, আগের বছরের আমদানি সংকোচন থেকে সরে আসার তাগিদও রয়েছে কারণ এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে অন্য এক সর্বনাশ উপহার দেয়। বিদ্যমান শুল্কের হার থেকে ৫-১০ এমন কি ১৫ শতাংশ কম হলে খুব তাড়াতাড়ি আমদানির অভ্যন্তরীণ দামে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে, সাথে সুবিধা দেবে আমদানি বিকল্প ও উৎপাদন খরচেও। অতি দ্রুত মূল্যস্ফীতি হ্রাস করতে জরুরি ভিত্তিতে রেগুলেটরি ডিউটি তুলে দেয়া উচিত। মোট কথা, উঁচু শুল্কের হার এবং মুদ্রার অবমূল্যায়নের মুখে আমদানি কর না কমালে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস