জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন ও আর্থ-সামাজিক প্যারামিটারে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে যখন স্বাধীনতা লাভ করে এমনকি ১৯৮০ সালেও অনেক পর্যবেক্ষক সন্দেহ প্রকাশ করেন, এ দেশটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে কি-না। কিন্তু আমরা তাদের সন্দেহকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়ন বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে হাজির হয়েছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানের প্রভাবশালী দৈনিক জাপান টাইমসে ‘বাংলাদেশ : একটি নতুন উন্নয়ন দৃষ্টান্ত’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন ও আর্থ-সামাজিক প্যারামিটারে বাংলাদেশ নতুন উন্নয়ন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের ধারণা আমরা মিথ্যা প্রমাণ করেছি। এটা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণোচ্ছ্বলতা এবং আমাদের সাহসী পদক্ষেপের সংমিশ্রণ, যা আমাদের প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেছে, মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে নিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ভিশন-২০২১, আমাদের দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার, এতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ গড়ার অঙ্গীকার রয়েছে, বর্তমানে এটি বাস্তব রূপ লাভ করেছে।২০০৫-০৬ অর্থবছরে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৪৩ মার্কিন ডলার। চলতি বছরের মার্চে তা বেড়ে এক হাজার ৪৬৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত সাত বছর ধরে বাংলাদেশে টেকসই জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৩ শতাংশ এবং চলতি বছরে আমরা তা ৭ দশমিক ০৫ শতাংশের প্রত্যাশা করছি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৫-০৬ সালের ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২৯ বিলিয়ন হয়েছে। দারিদ্রসীমা ১৯৯০ সালের ৫৬ শতাংশ থেকে ২০১৫ সালে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ নেমে এসেছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ কাজে লাগানোর উপর ভিত্তি করেই আমাদের উন্নয়ন করা হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিদেশি বিনিয়োগের জন্য একটি সক্রিয় পরিবেশ রয়েছে। আমাদের বিনিয়োগ ব্যবস্থা এই অঞ্চলের সবচেয়ে উদার ব্যবস্থার একটি। আমাদের বিনিয়োগ-বান্ধব নীতি বিদেশি বিনিয়োগের জন্য একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত গন্তব্যে পরিণত হয়েছে, ফলে দেশের বেসরকারি খাতে পুরোদমে এবং গতিশীল উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ঝুঁকি একেবারেই কম।বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের সুবিধা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, অবাধ প্রস্থান নীতিসহ আমরা শতভাগ বিনিয়োগের অনুমতি দেই। লভ্যাংশ সহজে দেশে পাঠানো, বিদেশি বিনিয়োগের নিরাপত্তা ও বিদ্যুতের স্থিতিশীল মূল্য বজায় থাকে। বাংলাদেশের নিজস্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকার জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে এবং বৈশ্বিক ইস্যু হলেও কার্যকরভাবে চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদের উত্থান মোকাবেলা করছে।গণকেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেলের মাধ্যমে বোঝার বদলে আমরা জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করেছি এবং আজ আমাদের দেশের প্রবৃদ্ধিতে ১২ থেকে ৬৪ বছর বয়সী ১০ কোটি ৫ লাখ মানুষ সরাসরি অবদান রাখছে। আমি দেখছি, আমাদের তরুণ কর্মশক্তি আমাদের উন্নয়ন দৃষ্টান্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। আমরা গত সাত বছরে অবকাঠামো, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগ ও বন্দরের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা তিনগুণ হয়েছে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নির্ধারণ করেছি। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।দেশের স্বপ্ন ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে এবং পায়রা এবং কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে আরো দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর শিগগিরই নির্মাণ করা হবে। আমরা দেশজুড়ে একশটি বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা নির্মাণ করতে যাচ্ছি, এতে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ ও ২০৩০ সালের মধ্যে এক কোটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। এর মধ্যে ৩৩টি নির্মাণাধীন রয়েছে এবং ২০১৭ সালের মধ্যে কমপক্ষে ১০টির নির্মাণ কাজ শেষ হবে। যদিও তৈরি পোশাক বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য, তৈরি পোশাক উৎপাদনে এ অঞ্চলের প্রধান বাজার হওয়ায় রফতানির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশে এখন জাহাজ থেকে চিপস সবকিছু উৎপাদন হয়। আমরা জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, কারিগরি দক্ষতা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও বিনিয়োগের জন্য একটি সমন্বিত নীতি প্রণয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। নারী উন্নয়ন নিয়ে সেভেন সামিটে আলোচনা করা হবে এটি দেখতে পেয়ে আমি খুশি। আমরা দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীকে মূলধারায় নিয়ে আসার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে আমাদের একটি উচ্চাশা আছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে, নারীদের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ তৈরি করা।আমরা নারীর শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক আত্মনির্ভরশীলতার উপর গুরুত্বারোপ করেছি এবং এই কৌশলের ফলাফল পেয়েছি। ২০১৪ সালের বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদনে ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৬৮তম স্থানে রয়েছে। আমরা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত মেয়েদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি এবং স্নাতক পর্যন্ত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ৭২ লাখ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন ধরনের বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আমরা সপ্তম স্থান অর্জন করেছি। বর্তমানে জাতীয় সংসদে ৭০ জন নারী রয়েছে এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সাড়ে ১২ হাজারেরও বেশি নারী নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা, বিরোধী দলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা এবং স্পিকার সবাই নারী। সাহসী পদক্ষেপ এবং সামাজিক সচেতনতার কারণে রাজনীতি ও নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য একটি সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে এটি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। জন্মহার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। ১৯৯০ সালের মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৯৭ জন থেকে এক তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে। গত বছর এই হার ছিল হাজারে ৩১ জন। একই সময়ে শিশুমৃত্যু হার দুই-তৃতীয়াংশ ও মাতৃমৃত্যু তিন-চতুর্থাংশ কমেছে। এখন জন্মকালীন শিশুমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৭৬ এ দাঁড়িয়েছে।জাপান টাইমসে প্রধানমন্ত্রী আরো লিখেন, বাংলাদেশ সত্যিই সম্ভাবনাময় একটি দেশ। আমাদের উন্নয়ন সে কথা বলে। আমরা হতাশাবাদীদের ভুল প্রমাণিত করেছি আর এটি হয়েছে আমাদের সংকল্প, আমাদের উদ্ভাবনী এবং অদম্য শক্তির পুনর্জাগরণের মাধ্যমে। আমরা দেখেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কীভাবে জাপান স্বল্প সময়ের মধ্যে পুনরুত্থান ঘটিয়ে একটি অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা এবং প্রতিজ্ঞা একটি অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।শেখ হাসিনা আরো লিখেন, আমি জনগণের ক্ষমতাকে বিশ্বাস করি, আমরা ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথে রয়েছি, যখন আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি পালন করবো এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশগুলোর কাতারে যোগদান করতে পারবো বলে আশা করি। আমাদের উন্নয়ন যাত্রায়, আমাদের জনগণের জীবনকে একটি উন্নততর বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে, একটি ভালো বাসযোগ্য পৃথিবী; একটি শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য এই অঞ্চল এবং বিশ্বের অন্যান্যদের সঙ্গে হাত মেলাতে চাই।ভাষান্তর : সাইফুজ্জামান সুমনএসআইএস/বিএ
Advertisement