ফিচার

জিপসি থেকে বেদে: যাযাবর জীবনের রহস্য

জিপসি থেকে বেদে: যাযাবর জীবনের রহস্য

রহস্যময় একদল মানুষ। যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াতেন পৃথিবীর এখানে-ওখানে। আজ এক জায়গায়, তো কিছুদিন পর দেখা যেত অন্যত্র। ১৪২৭ সালের দিকে প্যারিস নগরীতে হঠাৎ হাজির হয় এদেরই একটি দল। অদ্ভুত তাদের চেহারা, অদ্ভুত তাদের কথাবার্তা। উৎকণ্ঠিত প্যারিসকে তারা আশ্বস্ত করে বলে, তাদের আগমন লিটল ইজিপ্ট থেকে। পরে ইউরোপের নানা শহরে এদের দেখা যায়। ইউরোপ তখন একবাক্যে মেনে নেয় ‘এরা মিশরের মানুষ’। পণ্ডিতরা মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ওদের পোশাক, ভাষা, চাল-চলন সব ইজিপশিয়ানদের মতোই বটে।’ এই ইজিপশিয়ান থেকে ক্রমেই এদের নাম হয়ে গেল ‘জিপশিয়ান’, পরে ‘জিপসি’। দেশে দেশে অঞ্চলভেদে সৃষ্টি হয় তাদের বিভিন্ন নাম। আমাদের অঞ্চলের জিপসিরা পরিচিত হতে থাকে ‘বেদে’ নামে।

Advertisement

১৮৪০ সালে প্রকাশিত জেমস টেলরের ‘টপোগ্রাফি অব ঢাকা’ বইটিতে বেদেদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা রয়েছে। তিনি বেদেদের ‘ইনপিওর কাস্ট’ বলে অভিহিত করেছেন। জাহানারা হক চৌধুরী ‘পার্ল ওম্যান অব ঢাকা’ বইটিতে বেদেনীদের প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তিনিও বেদে সম্প্রদায়ের শেকড়ের সন্ধান দিতে পারেননি।

কথিত আছে, ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শরণার্থী আরাকানরাজ বল্লাল রাজার সঙ্গে তারা ঢাকায় আসেন। পরবর্তীকালে তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়। তারা প্রথমে বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করেন। পরে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও ছড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ১৯০৫ সাল থেকে ঢাকা পূর্ববঙ্গের রাজধানী হওয়ার পর বাড়তি সুইপার দরকার হয়। তখন ভারতের কানপুর, নাগপুর, তেলেগু ও মাদ্রাজ থেকে ‘ভালো’ কাজের কথা বলে তাদের আবার ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।

আজও খোলা আকাশের নিচে খুপরি অস্থায়ী ঘর বেঁধে থাকা একদল জনগোষ্ঠী বেদে। সমাজের কাছে তারা ‘বাইদ্যা’ নামে পরিচিত। সাপের খেলা দেখানো, মাছ ধরা, মসলা বিক্রি, করি মাছের হাড় বিক্রি, বাঁদরের নাচ দেখানো, চিকিৎসা ব্যবসা ও ওষুধ বিক্রিসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেন বেদেরা। নিজস্ব ভাবধারায় রচিত তাদের জীবন। আচরণে ও পেশায় ভিন্নতা থাকলেও বেদেরা এ দেশেরই নাগরিক। সব ধরনের নাগরিক সুবিধা তাদের প্রাপ্য হলেও আজও অমানবিক তাদের জীবন। তবে প্রযুক্তির ছোঁয়া, আধুনিকতার প্রভাব ও সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনে বেদেদের জীবনে এসেছে ইতিবাচক কিছু আর্থসামাজিক পরিবর্তন। যাযাবর জীবন পরিহার করে স্থায়ী বসতির চিন্তা এখন বেদেদের স্বপ্ন। শিশু শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধিসহ গাওয়ালি (ভ্রমণরত) বেদে সম্প্রদায়ের নানা পরিবর্তন এখন দৃশ্যমান।

Advertisement

জীবনযাত্রায় নতুন চিন্তাধারাবাংলাদেশে ক্রমহ্রাসমান জনগোষ্ঠী বেদে। বেদে মানে ভ্রমণশীল বা ভবঘুরে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসেবে এ দেশে বেদের সংখ্যা প্রায় ৬৩ লাখ হলেও ক্রমে ক্রমে তা কমতে চলেছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৭ লাখ বেদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সময়ের পরিবর্তনে বেদেদের মধ্যে কেউ কেউ শিক্ষা ও অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে বদলে নিয়েছেন পেশা ও পরিচয়। চাল-চুলোহীন জীবনের ইতি টেনে স্থায়ী বসতিতে বসবাসের ইচ্ছা অধিকাংশ বেদের নিত্যদিনের প্রচেষ্টার অংশ। জীবিকার তাগিদে বেদে জীবনে ঘটেছে নানামুখী পরিবর্তন। সামাজিকতার অনুকরণে এসেছে চাল-চলনের পরিবর্তন। কেউবা অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে স্থানান্তরিত হয়েছেন নতুন সামাজিকতায়।

পাল্টেছে পেশার চালচিত্রবেদেদের সার্বজনীন পেশা ছিল চিকিৎসা ব্যবসা ও ওষুধ বিক্রি। নানা রকম বুনো শেকড়, লতাপাতা তারা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে। চিকিৎসাপদ্ধতিতে ঝাড়ফুঁক ও মন্ত্রের প্রয়োগ বেশি। বাত ও দাঁতের ব্যথার চিকিৎসা, শিশু চিকিৎসা, মালিশ প্রভৃতিতে বেদেরা অভিজ্ঞ বলে বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। বর্তমানে বেদে চিকিৎসা গ্রহণে আধুনিক সমাজ অধিকতর সজাগ ও সচেতন। বেদে চিকিৎসা প্রণয়ন এখন আর লাভজনক নয়। গ্রামের মানুষের মধ্যেও এখন বেদে চিকিৎসা গ্রহণের প্রবণতা নেই। তাই বেদেরা বাধ্য হয়েই পেশা পরিবর্তন করে চলছেন প্রতিনিয়ত। পুরোনো এই পেশা বদলে নতুন বেদে জীবিকার সন্ধান করছেন অনেকেই। গ্রামে ঘুরে ঘুরে অনেক বেদেই ফেরি করে বিক্রি করছেন সিরামিক পণ্য, বাচ্চাদের খেলনা, নারীদের শাড়ি-কাপড়।

স্থায়ী নিবাসের চিন্তাধারাবেদেরা সাধারণত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে গ্রামে-গঞ্জে পরিভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণকে তাদের ভাষায় ‘গাওয়াল’ বলে। গাওয়ালের সময় তারা স্থানীয়ভাবে নৌকা, পলিথিন তাঁবু বা কোনো স্কুল ঘরের বারান্দায় সপরিবারে থাকেন। বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশালের অস্থায়ী বেদে পল্লিগুলো ঘুরে দেখা যায়, বেদেদের ব্যবসায়িক পরিবেশ আস্তে আস্তে মন্দা হয়ে আসছে। তাই তারা গাওয়াল জীবন ছেড়ে স্থায়ী কিছু করার চেষ্টা করছেন। তারা এখন জমি কিনে স্থায়ী বাড়িঘর নির্মাণ করছেন। স্থায়ী নিবাসের ব্যবস্থা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়ে আসছে তাদের জীবনতন্ত্র। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কর্ণকাঠি বহরের বেদে নসাই বলেন, ‘এই কামে এখন আর পয়সা নাই। বাপ-দাদারা কইরে গেছে তাই এই জীবনের লগে জরাইয়ে আছি। একটুখানি জমিন কিনতে পারলেই পরিবার লইয়ে এই গাওয়ালি (ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা) ছাইরে দেব।’

আরও পড়ুনলাশ-মাছ-যাত্রী সবই চলে একসঙ্গে, একই বাহনেপানির জন্য সংগ্রাম দেশে দেশে

জীবনে এসেছে প্রযুক্তির ছোঁয়াপ্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে বেদেপল্লিতে। স্বস্তির সন্ধানে তারাই আলোকিত করছেন নিজেদের ঘর। বেদেপল্লি ঘুরলে দেখা যেত কুপির আলোই ছিল তাদের একমাত্র ভরসা। তবে এখনকার গাওয়ালি বেদেপল্লিতেও দেখা যায়, সৌর প্যানেল ব্যবহার করে ডেরায় বাতি জ্বালাচ্ছে। সৌরবাতির ব্যবহার বেদেদের জীবনে পরিবর্তনের একটি উদাহরণ।

Advertisement

সমগ্র সমাজব্যবস্থা উন্নতির ফলে বেদে জীবনের উন্নতিও নিশ্চিত হয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে মোবাইল ফোনের ব্যবহার। বেদেরাও এখন প্রতিটি পরিবারে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। প্রতিটি ডেরায় স্বামী-স্ত্রী দুজনের না হলেও কমপক্ষে একজন মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। বেদেদের খুপরি ঘরেও ব্যাটারি-সাউন্ডবক্স ব্যবহার করে চলে গান। গরমকালে বাতাসের প্রয়োজনে চলে বৈদ্যুতিক পাখা। ছোট-ছোট টিভিও আছে তাদের ডেরায়।

পাল্টেছে জীবনাচরণবেদেরা সাধারণত গাওয়ালে বের হলে নৌকা ব্যবহার করতেন। নদীনির্ভর বাংলাদেশে এ বাহনেই অভ্যস্ত ছিলেন তারা। নৌকায় সংসার আবার নৌকা নিয়েই দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো ছিল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য। এখন বেদেরা গাওয়ালে এলেও নৌকার ব্যবহার করেন না। বাসের ছাদে ব্যবহার্য মালামাল তুলে নিয়ে টিকিট কেটেই চলে যান দূর-দূরান্তে। কিংবা বহরের সবাই মিলে মাহেন্দ্র বা মিনি ট্রাক ভাড়া করে চলে যান গন্তব্যে। তাদের জীবনব্যবস্থায় নৌকার উপস্থিতি এখন নেই বললেই চলে। নৌকা প্রথা বর্জন বেদেদের পরিবর্তনের আরেকটি উদাহরণ।

বেড়েছে সামাজিকতাসামাজিকতায় পিছিয়ে নেই বেদে জনগোষ্ঠী। আনুমানিক এক দশক আগেও বেদেপল্লি ছিল অসামাজিকতায় ভরা। তবে এখন বেদেপল্লিতে গেলে দেখা যায়, তারা অতিথিকেও চেয়ারে বসানোর ব্যবস্থা করেন। চায়ের আপ্যায়ন করেন। তাদের শিশুগুলোকে সবার সঙ্গে মিশতে দেন। আধুনিকতার প্রভাবে তাদের জীবনে এসেছে সামাজিকতা।

শিশুশিক্ষার ছোঁয়াক্রমে ক্রমে শিশুশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে বেদে পরিবারগুলো। বেদে পরিবারগুলোতে বেড়েছে শিশুশিক্ষার প্রবণতা। একটি পরিবারে প্রতিটি সন্তানকে না হলেও মেধা বিবেচনায় দুই-একজনকে তারা পড়ালেখা শেখাচ্ছেন। গাওয়ালে বের হলে তারা সব সন্তানকে সঙ্গে আনেন না। যারা সন্তানকে লেখাপড়া করান; তারা এখন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেন। তারা বলছেন, আর্থিক অবস্থায় পরিবর্তন এলে প্রতিটি শিশুকেই লেখাপড়া শেখাতেন বেদেরা।

বেদেদের জীবনব্যবস্থার এমন পরিবর্তন নিয়ে কথা হলে সেচ্ছাসেবী মানবাধিকার সংগঠন ‘নাগরিক অধিকার’র কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট সাইমুল ইসলাম রাব্বি বলেন, ‘বেদে জীবন ও জীবিকায় বংশগত পেশার টান নাজুক হয়ে আসছে নানা কারণে। তাদের জীবন ব্যবস্থায় আসছে বাধ্যগত পরিবর্তন। ইতিবাচক এই পরিবর্তনের পাশাপাশি উচ্চ মহলের সুদৃষ্টি আর বেদেদের পুনর্বাসন করা হলে দেশ আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। দরকার সহযোগিতা আর কর্ম পরিবেশ। দরকার এই গোষ্ঠীর উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ।’

শত পরিবর্তন সাধিত হলেও তাদের জীবন এখনো অমানবিক। বেদেরা আমাদের সমাজে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিষয়টি নিয়ে কথা হলে বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মু. ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘বেদেদের জীবনব্যবস্থার পরিবর্তন দেশের সার্বিক উন্নয়নের একটি প্রতিচ্ছবি। সমাজের অঙ্গ হিসেবে একটি জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদের সমাজে সাধারণ মানুষের মতো জীবন-যাপন করার সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য পেশা পরিবর্তনের সুযোগ করে দিতে পারলে এ অমানবিক জীবন থেকে মুক্তি পাবে বেদেরা। পরিবর্তনের এই বিপ্লবের পাশাপাশি সরকার এবং সচেতন মহলের সুদৃষ্টি আর সবার মানবিকতাবোধ অবসান ঘটাতে পারে বেদেদের অমানবিক জীবনের।’

এসইউ/জেআইএম