‘বাবা ক্যামনে (কীভাবে) তিন মাস আমার সংসার চালামু। আমার তো সব শ্যাষ অইয়া গ্যাছে। যত অভিশাপ গরিবের গায় (শরীরে) লাগে।’ পানিতে মরিচ গাছ দ্রুত পঁচনশীল হওয়ায় ফোরকান মোল্লা মরিচ নিয়ে সংসার পরিচালনার স্বপ্ন টিকিয়ে রাখতে পারেন নি। তাই গাছ তুলে ফেলছেন। পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের চর ওয়াডেলের বাসিন্দা ফোরকান মোল্লা বলেন, এ্যাহন এক মোন মরিচ পাইতে পারি। যদি এ্যাহন গাছ না উডাই তাহেলে হ্যাও পামু না। চলতি মৌসুমে স্থানীয় মাপের ২৪ কড়া (৭২ শতাংশ) জমিতে মরিচ চাষ করেন তিনি। স্বাভাবিক ফলন অনুযায়ী তার ওই জমিতে ৭ থেকে ৮ মণ মরিচ উৎপাদন হবে। ১৫ থেকে ২৫ দিনের ব্যবধানে ওই মরিচ গোলায় উঠবে। নিজের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি মরিচ বিক্রি করে ৮ সদস্যের সংসার চলবে প্রায় তিন মাস। কিন্তু মরিচ নিয়ে ফোরকান মোল্লার স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছি ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু। শুধু ফোরকান মোল্লাই না। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু পটুয়াখালীর শত শত প্রান্তিক কৃষকের স্বপ্ন ফিকে করে দিয়েছে। ফোরকান মোল্লার মরিচ ক্ষেতের ক্ষতস্থান পেড়িয়ে একটু দক্ষিণ পাশে গিয়ে দেখা গেছে মো. সাহেব আলী খা তিনি তার দুই সন্তানকে নিয়ে মরিচ গাছ তুলে ফেলছেন। রোয়ানুর আঘাতে তার আবাদও ক্ষতবিক্ষত। সাহেব আলী বলেন, স্যার যে ক্ষতি অইছে এইয়া পোশামু ক্যামনে। এ্যাহন দুই চাইর কেজি চাউল রিলিফ দেবে। এ্যাতে তো আমাগো দুই তিন মাসের সংসার চলবে না। সামনে রোজার ঈদ আইতে আছে। মরিচ শ্যাষ অওনে আমাগো খুব খারাপ অবস্থা যাইবে। কোন কোন ওক্ত (বেলা) না খাইয়া থাহন লাগবে। ফসল অইলে বউ পোলা মাইয়া লইয়া দুইডা ডাইল ভাত খাইয়া বাঁচতে পারি। এইরোম বইন্যা বাদল অইলে আমাগো খুব কষ্ট অয়। কোনো কোনো কৃষক একটু উঁচু জমিতে ফসল থাকায় দোয়া মিলাদ দিয়েছেন মসজিদে। একই এলাকার আব্দুর রহিম মৃধা প্রায় এক একর জমিতে বাদাম চাষ করেছেন। তার আবাদি জমি একটু উঁচু হওয়ায় পানি নেমে গেছে। মাঝে মধ্যে দুয়েক জায়গায় পানি জমে থাকলেও তা সেচ করে দিয়েছেন। কিন্তু বাদাম যাতে পঁচে না যায় এ কারণে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য চেয়ে সূর্য আর খরার প্রার্থনা করে দোয়া মিলাদ দিয়েছেন স্থানীয় মসজিদে। তিনি বলেন, আমাগো গরিবের এইয়াই সম্বল। খাওন-পরন, চলন-ফেরন এই মাডিতেই অয়। য্যা অওয়ার হ্যা তো অইয়া গ্যাছে। সব যেন শ্যাষ অইয়া না যায় এই লইগ্যা মিলাদ পড়াইছি। রোয়ানুর প্রভাবে পটুয়াখালীর কৃষকরা এখন দিশেহারা। তাদের নি:শ্বাস এখন দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে।গত রোববার একই উপজেলার সুলতানাবাদ গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, কৃষক সাইফুল মোল্লা এক একর জমিতে আবাদ করা চিচিঙা গাছ রোয়ানুর জলচ্ছাসে প্লাবিত হয়ে পুরো গাছ পঁচে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ৫০ হাজার টাকা খরচ করে ওই আবাদ করেছেন তিনি। সব কিছুই ছিল ঠিকঠাক। লাভ হওয়ারও কথা ছিল কয়েকগুণ। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু সব তছনছ করে দিয়েছে।উপজেলা কৃষি অফিসার সরোয়ার জামান বলেন, ঘূর্ণিঝড় পরর্বতী সময়ে কৃষকদের যা করণীয় আমরা সে ব্যাপারে তাদের পরামর্শ দিয়েছি। আমাদের কর্মীরা সার্বক্ষণিক মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে কৃষককে এ দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষার জন্য।জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রোয়ানুতে পটুয়াখালী জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে বাউফল উপজেলায় মরিচ ৩৭৫ হেক্টর, তিল ২৫ হেক্টর, বাদাম ৭ হেক্টর, গ্রীষ্মকালীন সবজি ৩১০ হেক্টর, আউশ বীজতলা ২ হেক্টর ও পানের বরজ ৩ হেক্টর। দশমিনা উপজেলায় মরিচ ৮০ হেক্টর, তিল ২৭ হেক্টর, বাদাম ১৬ হেক্টর, গ্রীষ্মকালীন সবজি ৯৭ হেক্টর, পানের বরজ ৫ হেক্টর ও আউশ বীজতলা ৬ হেক্টর। গলাচিপা উপজেলায় মরিচ ১৪০ হেক্টর, তিল ৬০ হেক্টর, গ্রীষ্মকালীন সবজি ৫৫ হেক্টর, পানের বরজ ১৫ হেক্টর ও আউশ বীজতলা ৫৪ হেক্টর। রাঙ্গাবালী উপজেলায় মরিচ ৩৫০ হেক্টর, তিল ১৬৬ হেক্টর, গ্রীষ্মকালীন সবজি ১৫০ হেক্টর ও আউশ বীজতলা ৭ হেক্টর। কলাপাড়া উপজেলায় গ্রীষ্মকালীন সবজি ১২০ হেক্টর ও আউশ বীজতলা ৫ হেক্টর। দুমকি উপজেলায় মরিচ ৯৬ হেক্টর, বাদাম ৫ হেক্টর, তিল ৫ হেক্টর, গ্রীষ্মকালীন সবজি ১১০ হেক্টর, পানের বরজ ১ হেক্টর ও আউশ বীজতলা ৪ হেক্টর। মির্জাগঞ্জ উপজেলায় মরিচ ৭২ হেক্টর, বাদাম ৫ হেক্টর, গ্রীষ্মকালীন সবজি ৯০ হেক্টর আউশ বীজতলা ৫০ হেক্টর। এছাড়া পটুয়াখালী সদর উপজেলায় মরিচ ১৬০ হেক্টর, তিল ১৫০ হেক্টর, বাদাম ৪০ হেক্টর, সবজি ৪৯০ হেক্টর পানের বরজ ২২ হেক্টর ও আউশ বীজতলা ১৫ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম মাতুব্বর বলেন, প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা নিরুপন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আশা করা যায় পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমবে। কৃষকদের সাহায্য সম্পর্কে বলেন, এটি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ব্যাপার।এমএএস/এবিএস
Advertisement