সাহিত্য

পথিকৃৎ নারী সাংবাদিক নূরজাহান বেগমের চলে যাওয়া

বেগম সম্পাদক নূরজাহান ছিলেন বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত এবং একজন সাহিত্যিক। অবহেলিত এবং পিছিয়ে থাকা এ দেশের নারী জাগরণের অন্যতম অগ্রদূতও। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নূরজাহান বেগম একজন সফল নারী। বেগম রোকেয়ার যোগ্য উত্তরসূরি কিংবদন্তি কলম সৈনিক নূরজাহান বেগম অক্লান্ত এবং অগ্রপথিক একজন নারী সাংবাদিক। সাংবাদিকতার মতো দুরূহ-কঠিন পেশাকে আজীবন সঙ্গী করে  দুস্তর পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তিনি কখনও পিছ পা হননি। সাংবাদিকতার মাধ্যমে অন্ধকার মহল থেকে বের করে এনেছেন এদেশের নারী সমাজকে। তিনি সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের কন্যা।ভারত উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’ পত্রিকার সূচনালগ্ন থেকে এর সম্পাদনার কাজে জড়িত ছিলেন এবং ছয় দশক ধরে বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর ডাক নাম ছিল নূরী। তিনি শুধু একজন সাংবাদিকই নন লেখক গড়ার কারিগরও। সাংবাদিকতার পাশাপাশি অবদান রেখেছেন সমাজ সংস্কারেও। উনিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের দিকে এদেশের বাঙালি নারীদের জন্য টিকে থাকার চেয়ে হারিয়ে যাওয়াটাই ছিল স্বাভবিক প্রবণতা। আর বাঙালি মুলসমান নারী মানেই অন্তঃপুরের বাসিন্দা। কিন্তু নূরজাহান বেগম ছিলেন এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। বাবা মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের হাত ধরে তিনি সাংবাতিদকতার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় যুক্ত হন। আর পরম আগ্রহভরে নিজ কাঁধে তুলে নেন এ দেশের নারীদের জন্য প্রকাশিত প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক ‘বেগম’ এর দায়িত্বভার।নূরজাহান বেগম ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুরের চালিতাতলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মা ফাতেমা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। তাঁর বাবার আদি নিবাস ছিলো কুমিল্লা জেলার (তৎকালীন ত্রিপুরা) চাঁদপুর মহকুমার অন্তর্গত পাইকারদী গ্রামে। এই গ্রামটি অনেক বছর আগে মেঘনার গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তাই তার পরিবার গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯২৯ সালে সাড়ে তিন বছর বয়সে মা আর মামা ইয়াকুব আলী শেখের সঙ্গে তিনি কলকাতায় বাবার বাসায় চলে যান। যা ছিলো কলকাতার ১১ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটের দোতলা বাড়ি, সওগাত পত্রিকার দপ্তর। সওগাত পত্রিকা অফিসে নিয়মিত সাহিত্য মজলিস বসত। যেখানে যোগ দিতেন কাজী নজরুল ইসলাম, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, হবীবুল্লাহ বাহার, ইব্রাহীম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ৷ এই সাহিত্য মজলিসের নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন নূরজাহান। তাঁর বেড়ে উঠার দিকে তাকালে দেখা যায়, তিনি সান্নিধ্য পেয়েছিলে আলোকিত মানুষের। পরিচয় হয় সৃজনশীলতার সাথে। এই ব্যক্তিদের গুণগুলোকে আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন নূরজাহান বেগম। তবে ছোটবেলায় তিনি ছিলেন খুবই চঞ্চল ছিলেন। তাঁকে সামাল দিতে মা, চাচা, চাচী, মামা, দাদী, নানা, নানিকে হিমশিম খেতে হতো। তার এই চাঞ্জল্যতা হয়তো তাকে তৈরি করেছিল সমাজের অন্যান্য নারী থেকে ব্যতিক্রম একজন নারী।নূরজাহান বেগমের লেখাপড়ার প্রথম হাতেখড়ি হয় মায়ের হাতে। শিশু বয়সেই নূরী বাবা নাসিরউদ্দীনের কাছে সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ নেয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য বাবা তাঁকে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলেন বেলতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখানে তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। পঞ্চম শ্রেণিতে আবার আগের বিদ্যালয়েই ভর্তি হন  সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে। সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর কিশোরী নূরী বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। ক্লাশে নাইটিংগেল, মাদামকুরি ইত্যাদি নামের দল ছিল। পড়ালেখার সঙ্গে সঙ্গে গানবাজনা, নাটক, রান্না, সেলাই, ছবি আকাঁ, খেলাধুলা সবকিছুতেই অংশ নেন। অষ্টম শ্রেণি থেকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত তিনি ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করেন। তিনি ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর আই.এ. ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে। তাঁর আই.এ.-তে পড়ার বিষয় ছিল দর্শন, ইতিহাস ও ভূগোল। এসময় তাঁর সহপাঠীরা মিলে একটি সাংস্কৃতিক দল তৈরি করেন। তিনি কলেজে কবিতা আবৃত্তি, নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখে, অভিনয়ের মাধ্যমে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। `মেঘদূত` নাটকে নাচের মাধ্যমে মেঘের গতিবিধি তুলে ধরে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। লেডি ব্রেবোর্ন থেকে ১৯৪৪ সালে আই.এ. পাশ করে বি.এ.-তে ভর্তি হন। শিক্ষা জীবনের তিনি প্রতিভার সাক্ষর রাখেন। অর্জন করেন সুকুমার গুণাবলী।তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয় ১৯৪৫ সাল থেকে। সে সময় প্রতি বছর এক বার ‘সওগাত’ পত্রিকার বিশষে নারী সংখ্যা বের হতো। ‘ জানালা মহল’’ নামে নারীদের একটি বিভাগ ছিল।‘জানালা মহল’র জনপ্রিয়তা থেকেই আসে নারীদের জন্য সাপ্তাহিক প্রকাশের ভাবনা। আর এই ভাবনা থেকেই ১৯৪৭ সালের দিকে ২০ জুলাই প্রকাশিত হয় বেগম এর প্রথম সংখ্যা। সে সময় নূরজাহান বেগম বিএ শ্রেণিতে পড়তেন। তাঁর বাবা নাসিরুদ্দীন প্রতিষ্ঠিত বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। প্রথম চার মাস সম্পাদক হিসেবে এর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।বেগমের শুরু থেকে নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তিনি বিয়ে করেন রোকনুজ্জামান খান (দাদা ভাই)কে। ১৯৫০ সালে তাঁরা বাংলাদেশে চলে আসেন। ঢাকায় এসে নারীদের ছবি আঁকতে, লেখার জন্য উৎসাহী দিতেন নূরজাহান বেগম, যাতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ে। যারা লেখা পাঠাত, তাদের ছবিও ছাপাতেন বেগম পত্রিকা। প্রথমদিকে পুরুষরাও এতে লিখতেন। তাই সাপ্তাহিক বেগমের সুবাদেও এদেশে তৈরি হয় একঝাক নতুন নারী লেখক, কবি ও সাহিত্যিক। বাবা নাসিরউদ্দিনের কাছ থেকে সম্পাদক নূরজাহান বেগম সব সময়ই প্রেরণা ও সর্বাত্মক সহযোগিতা লাভ করেন। নূরজাহান বেগম নানা প্রতিকূলতার মাঝে ধীরে ধীরে `বেগম` পত্রিকা নিয়ে অগ্রসর হন। এসময় সাহিত্য কর্মে মুসলমান নারী সমাজও অংশগ্রহণ শুরু করেন। ক্রমান্বয়ে সারা বাংলাদেশে ‘বেগম’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে মহিলা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। নূরজাহান বেগমের অক্লান্ত পরিশ্রম, আন্তরিকতা, কর্মনিষ্ঠা এবং মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের পৃষ্ঠপোষকতায় ’বেগম’ দ্রæত নারীদের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। ‘বেগম’-এ গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নিবন্ধের পাশাপাশি রান্না, সেলাই, সৌন্দর্য চর্চা, শিশু বিভাগ প্রভৃতি প্রকাশিত হওয়ায় প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের মেয়েরাও ‘বেগম’ পত্রিকার লেখকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।এই পত্রিকার মাধ্যমেই বাংলার মানুষ প্রথম অবহিত হন, সাহিত্য ক্ষেত্রে মুসলমান মেয়েদের পদচারণা শুরু হয়েছে। ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে `বেগম ক্লাব` প্রতিষ্ঠিত হয় যার প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, সেক্রেটারি হন নূরজাহান বেগম এবং বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন এর অন্যতম উপদেষ্টা। নূরজাহান বেগমের পারিবারিক জীবন ছিল খুবই সুখের এবং আনন্দময়। প্রগতিশীল, উদারচেতা, সংস্কারমুক্ত বাবার স্নেহের ছায়ায় বেড়ে ওঠায় তাঁর চিন্তা ভাবনায়ও এর প্রতিফলন ঘটে। মা ফাতেমা খাতুনের নিত্য সাহচর্য, চিন্তাচেতনা, জীবনবোধ তাঁর ওপর প্রভাব ফেলে। নূরজাহান বেগম অনেক সম্মাননা লাভ করেছেন এ পর্যন্ত। ১৯৯৬ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠ চক্রের সন্মাননা লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে রোকেয়া পদক, ১৯৯৯ সালে গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি থেকে শুভেচ্ছা ক্রেস্ট, ২০০২ সালে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৩ ও ২০০৫ সালে নারী পক্ষ দুর্বার নেটওয়ার্ক ও কন্যা শিশু দিবস উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে তিনি সংবর্ধনা লাভ করেন। এছাড়াও তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, চট্টগ্রাম লেডিজ ক্লাব, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিজ ক্লাব, ঋষিজ শিল্প গোষ্ঠী, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে। স্বর্ণপদক পেয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, লেখিকা সংঘ, কাজী জেবুনন্নেসা মাহাবুবুল্লাহ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ সাংবাদিক ফোরাম, রোটারি ক্লাব প্রভৃতি সংগঠন থেকে। ২০১০ সালে পত্রিকা শিল্পে তাঁর অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক নারী সংগঠন ইনার হুইল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮ সম্মাননা পান তিনি।এই মহান মানুষটি আমাদের মাঝ থেকে চিরতরে চলে গেলেন আজ। কিন্তু এ দেশের নারীদের জন্য তিনি যে অবদান রেখেছেন তা চির অম্লান হয়ে থাকবে। তিনি বেঁচে থাকবেন তার ‘বেগম’ পত্রিকার মাধ্যমে। নূরজাহান বেগম পরিচয় দিয়েছেন সাহসিকতা। নারীরাও যেকোনো পেশায় বা কর্মে নিয়োজিত হতে পারে, তা তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন। তিনি আমাদের নারী সমাজের জন্যও অনুপ্রেরণা এবং উৎসাহের অনন্য প্রতীক। কোনা বাধাই নারীদের রুখতে পারে না- তিনি তাঁর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার এই চলে আমাদের দুঃখিত এবং ব্যথিত করেছে। তবে তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন এই সমাজের জন্য রেখে যাওয়া তাঁর ব্যাপক অবদানের মাধ্যমে।এইচআর/আরআইপি

Advertisement