বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ ‘রাসেল ভাইপার’ নিয়ে কৃষকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দীর্ঘ ২৫ বছর পর ২০১৩ সালে আবারো এ সাপটির দেখা পাওয়া গেছে এ অঞ্চলে। ওই বছরই ভয়ঙ্কর এ সাপটি তিনজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে রাসেল ভাইপার। এ মৌসুমেই ইতিমধ্যে দুইজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এ সাপটি। তবে হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, রাসেল ভাইপার যে মানুষকে কামড়ায় তাকে বাঁচানো খুবই কষ্টকর। অনেক সময় রাসেল ভাইপারের বিষ নিস্ক্রিয় করা গেলেও কিছুদিন পর দংশিত স্থানে পচন ধরে। তারপর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ওই রোগী মারা যান।রামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ই মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের মেহেদি হাসান (১০) নামে এক কিশোরকে কামড় দেয় সাপটি। ওই কিশোরের বাবার নাম মানিক মিয়া। মেহেদি বর্তমানেও রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। মেহেদীর বাবা মানিক মিয়া জানান, ওইদিন বিকেলে মেহেদি মাঠে ঘাস কাটতে যায়। এসময় তার বাম পায়ে কামড়ায় রাসেল ভাইপার। পরে তাকে স্থানীয় ওঝার মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক দেয়া হয়। পরে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ১১ মে সকালে তাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রামেক হাসপাতালে পাঠান। এর আগে গত ২৯ এপ্রিল গোদাগাড়ী উপজেলার নিমতলা গ্রামে মৌসুমী খাতুন নামে এক নারীকে দংশন করে রাসেল ভাইপার। ওই দিন বিকেলে তিনি ধানের জমির আইলে ছাগল চরাতে গেলে তাকে এই বিষাক্ত সাপ কামড়ায়। তাকেও রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে এক সপ্তাহ চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। এদিকে, ২৬ এপ্রিল একই এলাকার নাইমুল ইসলাম (২৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে রাসেল ভাইপারের কামড়ে। জানা গেছে, ওইদিন নাইমূল ধানের জমিতে কাজ করছিলেন। এসময় তাকে রাসেল ভাইপারে কামড় দেয়। পরে তাকে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চার দিন চিকিৎসা দেয়ার পর গত ৩০ এপ্রিল তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। পরে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পথেই তার মৃত্যু হয়।একই গ্রামের জালাল শেখ জানান, গত বছর থেকে তাদের এলাকায় এ সাপ দেখা যাচ্ছে। গত বছর নদীতে জেলেদের জালে প্রথম একটি রাসেল ভাইপার আটকা পড়ে। খবর দেয়া হয় রাজশাহী চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষকে। তবে এমন ভয়ঙ্কর সাপ চিড়িয়াখানায় রাখার মতো কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পরে জালসহ সাপটিকে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। এর মাস দুয়েক পর আরেকটি সাপ এলাকার এক লোককে তাড়া করলে কৌশলে সাপটি ধরে তারা রামেক হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসকরা জানায়, এটিই ভয়ঙ্কর রাসেল ভাইপার।তিনি আরো জানান, ওই বছর তাদের পাশের গ্রাম মোলাপাড়ায় বিপ্লব (২০) এবং সাহেব আলী (৫৫) নামে দুইজন মারা যান এই সাপের কামড়েই। ওই বছরেই মোলাপাড়ার পাশের গ্রাম খরচাকায় শামীমা আক্তার নামে এক গৃহবধূকে কামড় দেয় একটি সাপ। তখন স্থানীয়রা গলায় ফলা ঢুকিয়ে সাপটিকে ধরে রামেক হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই সময় হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, এটিও প্রায় ২৫ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ভয়ঙ্কর বিষধর রাসেল ভাইপার সাপ। অপরদিকে, ২০১৩ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বরেন্দা গ্রামে আনোয়ার হোসেন (১৮) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয় রাসেল ভাইপারের কামড়ে। আনোয়ার হোসেনের হাতের আঙুলে কামড় দিয়েছিল এই সাপ। রামেকের আইসিইউতে ৮ দিন চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে তার আঙ্গুলে পচন ধরে। সে সময় তার আঙ্গুল কেটে ফেলা হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি।২০১৪ সালে রাজশাহীর তানোর উপজেলার শিবরাম গ্রামে তাইজুদ্দীন (২৫) নামে আরেক ব্যক্তি মারা যান রাসেল ভাইপারের কামড়ে। তাইজুদ্দিনের পায়ে কামড় দিয়েছিল এই সাপ। তাকেও রামেকের আইসিইউতে রাখা হয়েছিল ৯ দিন। কেটে ফেলা হয়েছিল তার পা। তারপরও রক্ষা করা যায়নি তার জীবন। একই বছরের ১ জুন নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আগ্রাদ্বিগুণ গ্রামে জামাল উদ্দীন (৩৫) নামে এক ব্যক্তি রাসেল ভাইপারের কামড়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাকেও বাঁচাতে পারেননি চিকিৎসকরা।এদিকে, গত ১৫ই মে রাজশাহী মহানগরীর হযরত শাহমখদুম ঈদগাহ ময়দান সংলগ্ন এলাকায় ৩৭ বডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা ‘সীমান্তে নোঙর’ ও ‘সীমান্তে অবকাশ’ নামে দুটি ফাস্ট ফুডের দোকানের পার্শ্বের জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে একটি রাসেল ভাইপারের দেখা পায় বিজিবি সদস্যরা। এসময় তারা এই ভয়ঙ্কর সাপটিকে মেরে ফেলে। আর এ নিয়ে ওই এলাকায় বসবাসকারীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে রামেক হাসপাতালের সাবেক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আজিজুল হক আজাদ জানান, প্রায় ২৫ বছর আগে বরেন্দ্র অঞ্চলে বিলুপ্ত হয়ে যায় এই সাপ। এরপর ২০১৩ সালে আবারো দেখা মিলেছে এই সাপের। অত্যন্ত বিষধর এই সাপ কাটলে অনেক সময় চিকিৎসা দেয়ার মতো সময় পাওয়া যায় না। সাপে কাটার কিছু সময়ের মধ্যেই রোগীর রক্ত জমাট বাঁধে। আবার সঠিক চিকিৎসায় রোগী সুস্থ হয়ে ওঠার পরও দংশিত স্থানে পচনের সৃষ্টি হয়ে রোগী মারা যাওয়ার নজিরও আছে।এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (আইসিইউ) চিকিৎসক আবু হেনা মোস্তফা কামাল জানান, রাসেল ভাইপারের কামড়ে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার জন্য গত বছর তারা একটি যন্ত্র পেয়েছেন। বাংলাদেশে শুধু রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই এ যন্ত্রটি দেয়া হয়েছে। তবে যন্ত্রটি চালানোর জন্য প্রতি ৭২ ঘণ্টায় ১টি করে সার্কিট প্রয়োজন। যার প্রতিটির দাম ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। তবে সরকারিভাবে এ সার্কিটের কোনো সরবরাহ না থাকায় যন্ত্রটি কোনো কাজে আসছে না। বিষয়টি লিখিতভাবে হাসপাতালের পরিচালক অবহিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।এ ব্যাপারে রামেক হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল কেএফএম রফিকুল ইসলাম জানান, সরকারিভাবে যন্ত্রটির সার্কিট বরাদ্দ চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানানো হয়েছে। তবে এখনো এ সংক্রান্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ। শাহরিয়ার অনতু/এআরএ/এমএস
Advertisement