ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালীতে দামে ধস নেমেছে। গতবছরের তুলনায় অর্ধেক দামে ফুল বিক্রি হওয়ায় মাথায় হাত উঠেছে চাষিদের। একদিকে উৎপাদন বেশি, অন্যদিকে চাহিদা কম; দুই মিলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে ফেব্রুয়ারি মাসের তিন দিবসে চাষিদের শতকোটি টাকার ফুল বিক্রির স্বপ্ন বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। এখন একুশে ফেব্রুয়ারি বাজার ভালো হলে ফুল বেচাকেনা অর্ধশত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করছেন চাষিরা।
Advertisement
যশোরের ঝিকরগাছার গদখালী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কাকডাকা ভোর থেকেই চাষিরা ফুল নিয়ে এসেছেন মোকামে। বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল ও ভ্যানে করে গোলাপ, গাঁদা, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, মল্লিকা, জিপসি ফুল ও কামিনী পাতা নিয়ে আসছেন চাষিরা।
দুই হাজারের বেশি চাষি এই মোকামে ফুল বিক্রি করতে পসরা সাজিয়ে বসেন। সেই ফুল কিনতে সারাদেশ থেকে পাইকারি ফুলের ক্রেতারাও বাজারে জড়ো হন। ভোর থেকে জমজমাট বেচাকেনা শুরু হয়। যা চলতে থাকে দুপুর পর্যন্ত।
ঝিকরগাছা উপজেলার টাওরা গ্রামের মিলন হোসেন ৮০০টি লাল গোলাপ নিয়ে এসেছিলেন গদখালী পাইকারি ফুলের মোকামে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে বিক্রি করতে পারছিলেন না।
Advertisement
আরও পড়ুন:
তিন দিবসে ৫০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা ব্যবসায়ীদেরমিলন হোসেন বলেন, ‘এ বছর গোলাপের বাজার ভালো না। প্রতিটি গোলাপের দাম ৭-৮ টাকার বেশি দাম কেউ বলছেন না। ব্যাপারীরা যে দাম বলছেন, তাতে উৎপাদন খরচ উঠছে না। গতবছরের তুলনায় এ বছর দাম অর্ধেকেরও কম।’
পাটুয়াপাড়া গ্রামের গোলাপচাষি মনিরুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘৩৬ শতক জমিতে গোলাপ ফুল চাষ করেছি। সকালে তিন হাজার গোলাপ নিয়ে বাজারে এসেছি। এরমধ্যে এক হাজার ২০০টি লাল গোলাপ ও এক হাজার ৮০০টি ক্যাপ পরানো গোলাপ রয়েছে। ক্যাপ পরানো গোলাপ পাঁচ টাকা ও ক্যাপ বাদে লাল গোলাপ সাড়ে ১১ টাকা করে বিক্রি করেছি।’ ফুলচাষিরা জানান, ৩৩ শতকের এক বিঘা গোলাপ চাষ করতে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। রোপণের তিন মাস পর থেকে ফুল কাটা যায়। একবার রোপণ করলে ১০-১২ বছর ফুল কাটা যায়। পরিচর্যার জন্য প্রতি মাসে সার, কীটনাশক ছিটাতে শ্রমিক খরচ হয় তিন থেকে চার হাজার টাকা। বছরে শীতের তিন মাস ফুলের ভরা মৌসুম। এই তিন মাস ফুল বিক্রির জন্য সারাবছর ক্ষেত পরিচর্যা করতে হয়। কিন্তু এ বছর ফুলের দাম পড়ে গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে গত বছরের তুলনায় এ বছর ফুলের দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে।
ফুলচাষি জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আট বছর ধরে আমি গোলাপ ফুলের চাষ করি। এ বছর ৩৮ শতক জমিতে চাষ করেছি। সকালে তিন হাজার গোলাপ হাটে এনেছি। সাড়ে তিন টাকা দরে প্রতিটা গোলাপ বিক্রি হয়েছে। এক লাখ ২০ হাজার টাকা উৎপাদন খরচ। এ বছর মাত্র ২৫ হাজার টাকার গোলাপ ফুল বিক্রি হয়েছে। লাভতো দূরের কথা, সারের দোকানে বকেয়াই পরিশোধ করতে পারছি না।’
Advertisement
আরও পড়ুন:
বিক্রি মৌসুম সামনে, তবুও দুশ্চিন্তায় ফুলচাষিরাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, জারবেরা ও গাঁদা ফুলের সরবরাহ অনেক বেশি। ঢাকা, বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ফুল কিনে বাসের ছাদ, মাইক্রোবাস, পিকাপে তুলে গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, মানভেদে প্রতিটা গোলাপ সাড়ে তিন থেকে ১৪ টাকা, গ্লাডিওলাস ৬-১২, রজনীগন্ধা ৩-৬, জারবেরা ১০-১৮, গাঁদা প্রতি হাজার ৫০০ টাকা, জিপসি ফুল প্রতিমুঠো ২০ ও কামিনী পাতা প্রতিমুঠো ৫০ টাকা দরে বেচাকেনা হয়েছে।
কথা হয় বরিশাল থেকে ফুল কিনতে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী তওসিফ রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর গোলাপ ও গ্লাডিওলাস কম দামে কিনেছি। গোলাপ, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, গাঁদা সব ধরনের ফুল কিনে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাচ্ছি।’
বসন্ত উৎসব, ভ্যালেন্টাইন দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘিরে যশোরের গদখালী এলাকার চাষিদের ব্যাপক প্রস্তুতি থাকে। প্রতিবছর ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি গদখালী বাজারে সবচেয়ে জমজমাট হাট বসে। চাষিরা এই দুটি দিনের অপেক্ষায় থাকেন সারাবছর। কিন্তু এ বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভ্যালেন্টাইন দিবসে পবিত্র শবে বরাত পড়ায় ফুল ব্যবসায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। দাম পড়ে যাওয়ায় ফুল চাষিদের মধ্যে হতাশা বেড়েছে।
আরও পড়ুন:
ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে ৫ লাখ টাকা বিক্রির আশাগোলাপ ও গ্লাডিওলাস ফুলের দাম কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, এ বছর হঠাৎ গরম পড়ায় ফুল বেশি ফুটেছে। গ্লাডিওলাসের উৎপাদন তুলনামূলক এবার বেশি। যে কারণে গেলাপের চাহিদা একটু কমেছে। এতে গোলাপ ও গ্লাডিওলাসের দাম কমেছে।
তিনি আরও বলেন, এ বছর ভ্যালেন্টাইন দিবসেই শবে বরাত পড়েছে। যে কারণে ফুলের খুচরা ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিচ্ছেন না। একই কারণে গতবছরের তুলনায় অর্ধেক দামে ফুল বিক্রি হয়েছে। ফলে এ মাসের তিন দিবসে শতকোটি টাকার ফুল বিক্রির স্বপ্ন ধাক্কা খেয়েছে। এখন একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে যদি বেচাকেনা ভালো হয়, তাহলে হয়তো ফুল বিক্রি ৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আবু তালহা বলেন, এখন ফুলচাষের ভরা মৌসুম। উৎপাদন বেশি। পহেলা ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাইন দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘিরে ফুলের উৎপাদন বাড়ে। এখন বাজারে চাহিদার তুলনায় ফুলের জোগান বেশি। যে কারণে দাম কিছুটা কমেছে। দু-একদিন পরে দাম আবার একটু বাড়বে বলে জানান তিনি।
এসআর/এমএস