মতামত

রাজনীতির অনন্য ভাষা

বহুবিচিত্র সংস্কৃতির দেশ আমাদের, নানা কারণে বা অকারণে চট করে এক-একটা সংবেদনে ঘা লেগে যায়। শিক্ষা এমন একটি বিষয় যেখানে প্রত্যাশা থাকে যে, বহুবিধ বুদ্ধিবৃত্তি ও দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা হবে অবারিতভাবে। ক্লাসরুমের ভেতরে, বাইরেও। সংকট তখনই চূড়ান্ত, যখন কারো ধর্মীয় সংবেদনে আঘাত লাগছে বলে জ্ঞানচর্চার পরিসর জোরজুলুম ছোট করে দেওয়া হয়।নারায়ণগঞ্জে পি আর সাত্তার স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে যা করেছেন স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমান তা কেবল একটি ঘটনা নয় এমন হাজারটির একটি। শিক্ষককে কান ধরে উঠ-বস করিয়ে তিনি সেই স্কুলের শিক্ষার্থীদের সামনে যে নজির সৃষ্টি করেছেন, তা যদি শিল্প হয় তবে তার কারিগর তিনি একাই। তবে এই কান ধরে উঠ-বস করানোর চেয়েও ভয়ংকর লেগেছে স্থানীয় এক সাংবাদিকের সঙ্গে তার ফোনালাপ। কি ভাষা, কি হুংকার! এমন অসাংস্কৃতিক ভাষা একজন আইন প্রণেতার হতে পারে তা ভাবা কষ্টকর। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো এই সংস্কৃতি বিরাজমান। আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতির চেহারাটাই এমন। সর্বগ্রাসী রাজনীতির ঘুণপোকা এখন আমাদের সবকিছুর মাঝে। এবং এই রাজনীতির সাফল্য এখন প্রশ্নাতীত। কোনো প্রাথমিক স্কুলের পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনও রাজনীতির রঙ ছাড়া অসম্ভব। ভাইয়ে-ভাইয়ে, বন্ধুতে-বন্ধুতে ঝগড়া, ফ্যাসাদ বাঁধলে নেতারা ফয়সালা করেন যেমনটা করেছেন সেলিম ওসমান। এমন দিন হয়তো আসবে স্বামী-স্ত্রীর বিবাদেও তারাই মধ্যস্থতা করবেন। সামিরক জান্তারা যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়ে গেছে তার বিনাশ নেই। বরং আরো বেশি পল্লবিত। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে। সন্ত্রাস আর সহিংসতা নির্ভর যে রাজনীতি তাকে লালন করাই দলগুলোর এখন অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র। দল প্রধানরা বলেন, তাদের দলের ভেতরে থাকা সন্ত্রাসী গড ফাদারদের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিতে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু তারা পারেন না। তাদের মেনে নিতে হয় যে, এই রোগ কেবলমাত্র উপরিভাগের নয়, এর শিকড় অনেক গভীরে রয়েছে। অথবা তারা জানেন এই অসংস্কৃতির গাছ তারাই লাগিয়েছেন। বহু লোক রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ হয় শুধুমাত্র দলের আধিপত্যের ভাগ পাওয়ার আশায়। আদর্শ, দলীয় দর্শন তাদের কাছে কিছুই নয়। সরকারি দল হলে নির্বিঘ্নে পাওয়ার আশা থাকে অনেক বেশি। দলীয় পরিচয় তাদের কাছে যথেচ্ছাচারের লাইসেন্স মাত্র। এবং বর্তমান বাংলাদেশে তারা কারা এই প্রশ্নের উত্তর বড় কঠিন। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার মতো অবস্থা। কে নেই? ছিচকে চোর থেকে বড় দস্যু, পাড়ার মাস্তান থেকে বড় সন্ত্রাসী ও খুনি। তারা দল করে, তারাই সিন্ডিকেট। বাকিরা কেবল আজ্ঞাবহ কর্মী।রাজনীতির এমন সংস্কৃতি থেকে শ্যামল কান্তি ভক্তদের বাঁচাতে পারে কেবল একটি দক্ষ প্রশাসন। শ্যামল কান্তির সঙ্গে যখন অন্যায় হচ্ছিল, তখন সেখানে পুলিশের কর্তা ছিলেন। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ছিলেন, একজন জেলা প্রশাসকও ছিলেন। কিন্তু কেউ আইন ভঙ্গকারীকে কিছু বলতে সাহস পাননি। সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট ও রাজনীতির অশুভ যোগাযোগ ভাঙ্গার একটিই দাওয়াই আর তা হলো প্রশাসনকে রাজনৈতিক রঙ-নিরপেক্ষ হতে হবে। যে আইন ভাঙবে, যে জুলুম করবে, পুলিশ তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিবে, প্রশাসন তার বিরুদ্ধেই আইন প্রয়োগ করবে। দুর্ভাগা দেশে যদি কখনও এই নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয়, তবেই এই অশুভ চক্র ভাঙবে।নির্বিচার হিংসার বিরুদ্ধে আত্মমর্যাদার শক্তি জনগণ চায়। কিন্তু যে রাজনীতি এখন চর্চা হয় তার ভাষা সেলিম ওসমানদের সেই ফোনালাপের মতো। শোনা যায় না, নেয়া যায় না। কোথা থেকে এলো রাজনীতির এমন অনন্য ভাষা? যুক্তি অযুক্তি প্রতিযুক্তি সবই তিরোহিত। কেবল আছে অসুস্থ বাহুবলীয় রাজনীতি। এটাই সহিংস রাজনীতি। সহিংসতা কেবল আগুন জ্বালানোর মধ্যে নয়, ভাংচুরের মধ্যে নয়। সহিংসতা বিরাজ করে মনস্তত্বে যেখান থেকে এমন ভাষা বের হয়, তার প্রয়োগও হয়।গত কয়েক দশক ধরে দেশের সর্বত্র রাজনীতির যে পরিকল্পিত দুর্বৃত্তায়ন ঘটানো হয়েছে, যেভাবে প্রতিটি এলাকার চিহ্নিত সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতকারীদের দলে-দলে পার্টির ছায়ায় আশ্রয় দেয়া হয়েছে, যেভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে গড ফাদারদের পক্ষে হাই কমান্ড অবস্থান নিয়েছে, তাতে এরা কেবল প্রশ্রয় পেয়েছে। প্রশ্রয়, প্রশ্রয় আর প্রশ্রয়। আসকারা পেয়ে পেয়ে আজ তারা সব আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করেছে নিজেদের।একটা সময় ছিল অন্য দলের লোকদের শায়েস্তা করতে ভাড়ায় দুষ্কৃতী নিয়োগ করা হতো। এখন ভাড়া নয়, দুষ্কৃতকারীরাই দলীয় উচ্চ পর্যায়ের প্রশ্রয়ে দলের জন্য সম্পদ হিসেবে বিকশিত হয়ে উঠেছে। অন্য দল নয়, নিজ দলের নেতা কর্মীরাই এখন এদের কাছে নিরাপদ নয়। দল যায়, দল আসে। দুষ্কৃতকারীরা অনেকেই কেবল তাদের ছত্রটি পরিবর্তন করে, রাজনীতির রীতি অপরিবর্তিতই থাকে। এমন সাংসদরা লাগাতার সব প্রশ্রয়ের ফসল। আগলে রাখতে রাখতে এখন উড়লে ফেলাও কঠিন হয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের জন্য।দুর্নীতি আর ক্রমবর্ধমান অন্যায় প্রবণতার সঙ্গে রাজনীতির কেবলই আন্তরিকতা এখন। ক্ষমতা ও পেশীশক্তির উপর রাজনীতি এতটা নির্ভরশীল হওয়ায় অসাংস্কৃতিক লোকজনের আধিপত্য বাড়ছে। মানুষের আধুনিকতার স্বপ্ন, আধুনিক জীবনযাপনের ইচ্ছা আছে। কিন্তু তার সাধ পরাভূত কুৎসিত সামন্ত সংস্কৃতির এমন রাজনীতিতে। শাসক দলের সমর্থন-ভিত্তির মধ্যে যে বিশালাকার মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা রুচির চর্চা করেন তারা না পারছে এ রাজনীতি মানতে, না পারছে মধ্যযুগীয় ভাবধারার মৌলবাদি প্রতিক্রিয়াশীলদের সমর্থন দিতে। তাদের মেনে নিতে হয় যে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভরণপোষণের সমস্ত ভার যারা কান ধরায় তাদের হাতেই।আরএস/এইচআর/এমএস

Advertisement