উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় কমলা চাষে সফলতা

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া
প্রকাশিত: ১২:৩২ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় বাড়ছে কমলা চাষ, ছবি: জাগো নিউজ

দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় বাড়ছে কমলা চাষ। আবহাওয়া ও মাটির গুণগত মানের কারণে এ অঞ্চলে চায়না কমলা, দার্জিলিং মাল্টা এবং ম্যান্ডারিন কমলা চাষ লাভজনক হয়ে উঠেছে। চাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় বদলে যাচ্ছে অর্থনীতির চিত্র।

বগুড়ার সাফল্যের গল্প

বগুড়ার গোবরধনপুর গ্রামের চাষি মো. আবদুল আজিজ চায়না কমলা চাষ শুরু করেছিলেন ২০১৯ সালে। দুই বিঘা জমিতে গড়ে তোলা বাগানে এখন ২০০ গাছ থেকে ফল উৎপাদন হচ্ছে। তার বাগানে চায়না, দার্জিলিং এবং ম্যান্ডারিন কমলাসহ লাল আঙুর, থাই আঙুর এবং দেশি জাতের আঙুরও চাষ করছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ টাকার ফল বিক্রি করেছেন।

আবদুল আজিজ বলেন, ‘ইউটিউবে দেখে কমলা চাষে আগ্রহী হই। সন্তানদের অনুপ্রেরণায় এই যাত্রা শুরু করি। বর্তমানে বাজারে ভালো চাহিদা থাকায় দামও ভালো পাচ্ছি।’

গোবরধনপুর এলাকায় বেশ কয়েকজন ছোট পরিসরে চায়না কমলা চাষ শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরীক্ষামূলকভাবে লেবু ও মাল্টা চাষ করেও ভালো ফল পাচ্ছেন।

পঞ্চগড়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন

উত্তরের পঞ্চগড় জেলা এরই মধ্যে চা চাষের জন্য পরিচিতি পেলেও এখন কমলা চাষে বড় পরিবর্তন এসেছে। তেঁতুলিয়া ও বোদা উপজেলার চাষিরা পাহাড়ি এলাকায় কমলা চাষ শুরু করেছেন। তারা বলছেন, ‘পাহাড়ি জমি এবং প্রাকৃতিক জৈব সার ব্যবহারের কারণে ফলন ভালো হচ্ছে।’

উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় কমলা চাষে সফলতা

তেঁতুলিয়ার চাষি আব্দুল কাদের বলেন, ‘চা চাষের পাশাপাশি কমলা চাষ আমাদের জন্য একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এখানে প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারে আমরা আরও লাভবান হতে পারবো।’

রংপুর ও দিনাজপুরের সম্ভাবনা

রংপুরের মিঠাপুকুর ও দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায় বেশ কয়েকজন চাষি ছোট পরিসরে চায়না ও দার্জিলিং মাল্টা চাষ করছেন। সরকারি সহায়তা পেলে এ অঞ্চলে কমলা চাষ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে পারে। চাষিরা জানান, কমলায় বাজার চাহিদা অনেক বেশি। বিষমুক্ত ফল হওয়ায় ক্রেতাদের আস্থা বেড়েছে।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, চাষিদের প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে ফলন আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।

গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামে পরীক্ষামূলক চাষ

গাইবান্ধার সাঘাটা ও কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে ম্যান্ডারিন কমলা চাষ করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এলাকায় ফলন ভালো হওয়ায় স্থানীয় চাষিদের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে।

চাষি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ম্যান্ডারিন কমলার ফলন আশানুরূপ হওয়ায় আমি আগামী বছর আরও জমিতে চাষ করার পরিকল্পনা করছি।’

প্রযুক্তিগত সহযোগিতা

উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে কমলা চাষ আরও সহজ ও ফলপ্রসূ হচ্ছে। ড্রিপ ইরিগেশন এবং আধুনিক সেচ ব্যবস্থার প্রয়োগ চাষিদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। স্থানীয় কৃষি অফিস চাষিদের প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে।

আরও পড়ুন

কমলা প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ

চাষিদের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো উত্তোলিত কমলা সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত হিমাগার এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রের অভাব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরির জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে। রস, জ্যাম, জেলি এবং অন্য পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ আছে।

উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় কমলা চাষে সফলতা

বাজারজাতকরণেও বিশেষ অগ্রগতি হচ্ছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং সরাসরি পাইকারদের মাধ্যমে ফল বিক্রি করছেন চাষিরা। বিষমুক্ত ও জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফলের কারণে ক্রেতাদের আস্থা বেড়েছে।

কৃষি বিভাগের ভূমিকা

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলে কমলা চাষের জন্য পরিবেশ অত্যন্ত উপযোগী। আমরা চাষিদের জৈব সার ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছি। এতে ফল মিষ্টি এবং বিষমুক্ত হয়।’

পঞ্চগড় ও দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, নতুন প্রযুক্তি ও উন্নত জাতের চারা সরবরাহের মাধ্যমে চাষিদের আরও সহায়তা করা হবে।

অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক

কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে মুনাফা বাড়ানোর জন্য চাষিদের উন্নত জাতের চারা বিতরণ, জৈব সার ব্যবহারের প্রশিক্ষণ এবং ড্রিপ ইরিগেশন প্রযুক্তি সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও আছে। যা চাষিদের ফল বিক্রির সুযোগকে আরও বিস্তৃত করবে।

উত্তরাঞ্চলের চাষিরা জানিয়েছেন, কমলা চাষে তুলনামূলক কম খরচে বেশি মুনাফা অর্জন সম্ভব। প্রায় ১ লাখ টাকা খরচে দুই বছরের মধ্যে তিন থেকে চার গুণ লাভ করা সম্ভব।

চাষি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কমলা চাষের পাশাপাশি লেবু ও আদার মতো সাথী ফসল চাষ করায় আমার আয় অনেক বেড়েছে।’

পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় পরিকল্পিত চাষ ও বাগান সম্প্রসারণের মাধ্যমে কমলা আমদানির প্রয়োজন কমানো সম্ভব। এতে স্থানীয় অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রশিক্ষণ, চারা বিতরণ এবং কমলা প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র স্থাপন করা হলে এ অঞ্চল আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে।

উত্তরাঞ্চলের চাষিদের এমন সাফল্য দেশের অন্য অঞ্চলের চাষিদেরও উদ্বুদ্ধ করছে। সরকারের আরও সহযোগিতা পেলে উত্তরাঞ্চল হতে পারে কমলা উৎপাদনের নতুন হাব।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।