সিলেটে নাগা মরিচ চাষে লাখপতি ৭ শতাধিক পরিবার

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি সিলেট
প্রকাশিত: ১২:৩৯ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩

মাত্র ৫-৬ বছর আগে কেউ কেউ শখের বশে নাগা মরিচের চাষ করতেন। পরিবারের চাহিদা মেটাতে বাড়ির আঙিনায় শোভা পেত নাগা মরিচের গাছ। ছিল না লাভের আশা। ছিল না বাণিজ্যিক চিন্তা। পাঁচ বছরের মাথায় পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। বাড়ির আঙিনা ছাড়িয়ে ফসলি জমিতে এখন চাষ হচ্ছে নাগা মরিচ। বাণিজ্যিক ভাবে নাগা মরিচ চাষ করে লাখপতি সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার প্রায় ৭ শতাধিক পরিবার।

উপজেলায় উৎপাদিত নাগা মরিচ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার নাগা মরিচ বিক্রি করেন কৃষকেরা। অল্প পুঁজিতে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি লাভের কারণে নাগা মরিচ উৎপাদনে ঝুঁকছেন তারা। উপজেলার হরিপুর, উপরশামপুর, দলইপাড়া ও ছয়কুরিবন্দসহ (বড় হাওর) বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক হারে বেড়েছে নাগা মরিচের চাষ। এছাড়া সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও সদর উপজেলার একাংশে নাগা মরিচের চাষ হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৬৮৫ জন কৃষক নাগা মরিচের চাষ করছেন। তবে হিসেবের বাইরেও অনেকে এ ফসল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। নাগা মরিচ চাষ করে তারা সবাই এখন স্বাবলম্বী।

jagonews24

প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার নাগা মরিচ উৎপাদন হলেও কৃষি অফিসের কাছে এর ‘গুরুত্ব’ কম। সম্ভবনাময় এ খাতকে এগিয়ে নিতে সার বিতরণ ছাড়া কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি নাগা মরিচের মাঠে যাননি কোনো কৃষি কর্মকর্তা। কেবল নিজের বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল কাজে লাগিয়েই নাগা মরিচ চাষ করছেন কৃষকেরা।

কৃষকেরা বলেন, ‘কৃষি অফিসের সহযোগিতা ও পরামর্শ পেলে নাগা মরিচের চাষ আরও লাভজনক অবস্থায় পৌঁছাবে। অনেক কৃষক এটি চাষে আরও উদ্বুদ্ধ হবেন। সরকারেরও রাজস্ব বাড়বে।’

আরও পড়ুন: জয়পুরহাটে পানিফলে লাভবান চাষিরা 

হরিপুরের উপরশামপুরের ইমাম উদ্দিনের ছেলে বেলাল আহমদ এ বছর দেড় বিঘা জমিতে চাষ করেছেন নাগা মরিচ। জমি লিজ, সার ও কীটনাশকসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় হয়েছে ১ লাখ টাকা। ফলন ভালো হলে এই দেড় বিঘা জমি থেকে ৫-৬ লাখ টাকার নাগা মরিচ বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান তিনি।

জাগো নিউজকে বেলাল আহমদ বলেন, ‘গত বছর তিন বিঘা জমিতে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে নাগা চাষ করে ৭ থেকে ৮ লাখ লাভ হয়েছে। এবার আরও অনেক কৃষক নাগা মরিচের চাষ শুরু করেছেন। যার কারণে জমি না পাওয়ায় এবার কম চাষ করতে হয়েছে। তবে ভালো ফলন হলে এবারও লাভ হবে।’

তিনি বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে যখন চাহিদা বেশি থাকে; তখন ৫০ কেজি সমপরিমাণ বস্তা নাগা মরিচ ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। পরে আস্তে আস্তে দাম কমে। ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে বেশিরভাগ মরিচ বিক্রি করা হয়। স্থানীয়রা কেজি দরে নাগা মরিচ কিনে থাকেন। সে ক্ষেত্রে কেজি ৪০০-৫০০ টাকা পড়ে।’

জৈন্তাপুরের ছয়কুরিবন্দ হাওরে (বড় হাওর) গত ৫-৬ বছর ধরে নাগা চাষ করে আসছেন দলইপাড়া গ্রামের তরিকুল্লাহ, হরিপুর বাজার কমিটির সদস্য সিরাজ উদ্দিন কালা, পুতুল মিয়া, মনির উদ্দিন, সমছুর উদ্দিন ও সিরাজ উদ্দিন। লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই নাগা মরিচ উৎপাদন করছেন তারা।

কৃষক তরিকুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিলেটের নাগা মরিচের অনেক চাহিদা আছে। অন্য এলাকার চেয়ে সিলেটের নাগার গুণগত মান ও আকার বড় হওয়ায় ঢাকা থেকে ব্যবসায়ীরা সরাসরি সিলেটে চলে আসেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সহায়তায় মাঠ থেকেই নাগা মরিচ কিনে নিয়ে যান।’

আরও পড়ুন: চাঁপাইনবাবগঞ্জে পেঁয়াজের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা 

তরিকুল্লাহ বলেন, ‘ভালো ফলন ও দ্বিগুণের চেয়েও বেশি লাভ হওয়ায় জৈন্তাপুরের কৃষকেরা নাগা মরিচ চাষে ঝুঁকছেন। কিন্তু সে তুলনায় কৃষি কর্মকর্তাদের তৎপরতা নেই। আমরা যোগাযোগ করেও তাদের মাঠে আনতে পারিনি। ইউনিয়নে ডেকে নিয়ে কিছু সার দেওয়া ছাড়া আর কোনো খোঁজ-খবর রাখেন না। মাঠে এসে জমি সম্পর্কে ধারণা দিলে এবং কৌশল শেখালে হয়তো নাগা মরিচের চাষ আরও লাভজনক হতো।’

স্থানীয় নাগা মরিচ ব্যবসায়ী শফিক মিয়া বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে নাগা মরিচের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমি হরিপুর, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাটসহ বিভিন্ন এলাকার কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নাগা মরিচ সংগ্রহ করি। এসব নাগা মরিচ ঢাকার যাত্রাবাড়ী, গাজীপুর, কারওয়ানবাজার, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করি।’

jagonews24

তিনি বলেন, ‘প্রথম অবস্থায় কেজি ৭০০-৮০০ টাকা দরে কিনি। এক কেজিতে ২০০ পিসের মতো থাকে। পরে কিছুটা কম দামে কেনা যায়।’ হরিপুর এলাকা থেকে প্রতিদিন ৩০ কেজি ওজনের ৪০-৪৫ কার্টুন নাগা মরিচ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সিলেটে ৫০ হেক্টর জমিতে নাগা মরিচ চাষ করে ২২৫ হেক্টর উৎপাদন হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৩ হেক্টর জমিতে চাষ করে ২৫০ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে নাগা মরিচের চাষ বেড়ে ১৪১ দশমিক ৫ হেক্টরে। তবে ওই অর্থবছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ১৫৬ মেট্রিক টনে। গত বছরের তুলনায় এ বছর উৎপাদন আরও বেড়েছে এবং ফলনও ভালো হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের উপপরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘সিলেটে প্রধান অর্থকরি ফসল ধান। কিন্তু এখন ধানের পাশাপাশি শিম, জারা লেবু, ফরাসেরও উৎপাদন বাড়ছে। সম্প্রতি নাগা মরিচও ব্যাপক হারে উৎপাদন হচ্ছে। সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় ৬ শতাধিক কৃষক নাগা মরিচ চাষ করছেন। ভালো ফলন হওয়ায় তারা প্রচুর লাভবান হচ্ছেন।’

আরও পড়ুন: নীলফামারীতে কলার সাথী ফসলে আগ্রহী চাষিরা 

তিনি বলেন, ‘আমাদের জনবল কম থাকায় মাঠপর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে নাগা চাষের কলা-কৌশল নিয়ে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে কৃষকদের অবহিতকরণ সভা হয়। তাছাড়া সার কীটনাশক বিতরণ করা হয়।’

এ কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘দেশে ও দেশের বাইরে সিলেটের মানুষের কাছেই নাগা মরিচের চাহিদা বেশি। তাই সিলেটিরা যেসব দেশে আছেন; সেখানে নাগা মরিচ রপ্তানি করতে পারলে উৎপাদন আরও বাড়বে।’

আহমেদ জামিল/এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।