পরিবেশ-শিক্ষা টেকসই উন্নয়নের হাতিয়ার

ড. কে এম আতিকুর রহমান
ড. কে এম আতিকুর রহমান ড. কে এম আতিকুর রহমান
প্রকাশিত: ০৪:১২ পিএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

২০২৩ সালে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আকস্মিক বন্যা পরিবেশ-শিক্ষার অভাবকেই সামনে নিয়ে এসেছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের উদাহরণ এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে? উন্নয়নমূলক কাজের সময় পরিবেশ-প্রতিবেশের কথা মাথায় না থাকায় শুধু দক্ষিণ চট্টগ্রামই নয়, চট্টগ্রাম মহানগরও এর শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের অন্য ক্ষেত্রে পরিবেশগত বিপর্যয়ের জন্য পরিবেশ-শিক্ষার অভাব, লোভ, অনিয়ম ও দখলী প্রক্রিয়াই মূলত দায়ী। প্রতিদিন গড়ে ১০ জন লোক মারা যাচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। এটা মূলত পরিবেশ-শিক্ষাকে মাথায় না নেওয়ার জন্যই। আমাদের শিশুরা প্রতিমাসেই একাধিকবার জ্বর, স্বর্দি, কাশি, ডায়রিয়ার মতো পরিবেশগত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর কারণ হলো আমাদের এমন কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যা পরিবেশগত দিক থেকে নির্মল ও পরিচ্ছন্ন। এগুলোর মূল কারণ হলো অধিকাংশ জনগণের পরিবেশ-শিক্ষা নেই বললেই চলে। ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক কোনো পর্যায়েই পরিবেশকে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় হিসেবে দেখা হয়, তা আমার জানা নেই।

পাঠ্যপুস্তকে পরিবেশ রক্ষার কথা তত্ত্বাকারে তোতা পাখির বুলি হিসেবে আওরানো হয়। আমেরিকা বা চীনের কোনো তাত্ত্বিক যেভাবে বলেছেন, আমাদের কারিকুলামগুলো যেন তার পরোক্ষ কপি। প্রতিটি সমস্যা একেক জায়গায় একেক রকম আচরণ করে। বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার সমাধান আমেরিকার ল্যাব উৎসারিত তত্ত্বকে হুবহু বইতে তুলে ধরে বাচ্চাদের সামনে দিলেই হয় না। বাস্তবতা নির্ধারণ করাই হচ্ছে প্রথম গবেষণা। আমাদের সমস্যা আমাদের মতো করে পুস্তকে সন্নিবেশ করে তার সমাধান খুঁজতে হবে। নচেৎ প্রজেক্ট হবে, টাকা কারো কারো পকেটে যাবে; কিন্তু সমস্যা আরও বাড়তে থাকবে। ঢাকা মহানগরের ৩৫টি খাল কোথায় ছিল, তা-ই হয়তো আজ কেউ বলতে পারবে না। প্রতিটি খালেরই নিঃসরণ মুখ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা বা বংশাই নদীতে শেষ হয়েছিল। কিন্তু খালগুলোর উৎস বা নিঃসরণ মুখ আজ বিবর্ণ ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। কারণ পার্শ্ববর্তী নদীগুলোই আজ কাফনের কাপড় মুড়িয়ে কবরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দখলে-দূষণে আজ তারা আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। নগর ও কারখানার অপরিশোধিত-বিষাক্ত বর্জ্য পাইপলাইনের মাধ্যমে ওই সব নদী ও জলাশয়ে ফেলা হচ্ছে। দেখার কেউ নেই; তবে দূষণকারী-দখলকারীর সঙ্গী-সাথীর অভাব নেই। কারখানা, বাড়ি-ঘর নির্মাণের জন্য প্রত্যেককেই পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে হয়। কিন্তু ছাড়পত্র প্রদান করা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে আন্ডার-টেবিল ডিলিংসের মাধ্যমে। কারণ সরেজমিনে পরিদর্শন বলতে টেবিলের নিচের জায়গাকেই যেন বোঝানো হয়। টেবিলের নিচের কাজ-কারবার বাকি-বকেয়া হলেই কেবল সরেজমিনে যাওয়া হয়। টেবিলের নিচের কারবার যত বাড়ে, শীতলক্ষ্যারা ততই মরে। যে ছাড়পত্র দিচ্ছে তার শিক্ষা সনদ আছে; তবে দেশপ্রেম, পরিবেশের অন্তর্নিহিত শিক্ষা নেই। আবার বাড়ির বা কারখানার মালিক যারা খাল-নদী দূষিত করে হত্যা করছে, তাদেরও শিক্ষা সনদ আছে। কিন্তু টাকা কামানোর লোভ সম্বরণ করার মতো শিক্ষা অন্তরে নেই। আর পরিবেশের পাঠ নেওয়া মানে তারা মনে করে এটি পরিবেশবাদীদের বিলাসিতা-চিল্লাচিল্লি বৈ কিছু নয়। কারণ তারা মনে করেন, পরিবেশবাদীরা অর্থনীতির কিছু বোঝে না; তারা দেশের উৎপাদনকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়।

আরও পড়ুন: স্মার্ট কৃষিকে সক্ষম করবে যেসব প্রযুক্তি 

পরিবার ও শিক্ষালয় যেখানে পরিবেশের শিক্ষার হাতেখড়ি হবে; সেখানেও তথৈবচ অবস্থা। শিশুরা প্রতিনিয়ত দেখছে মা-বাবা জানালা দিয়ে থু থু ফেলছেন, ছেঁড়া কাগজ ফেলছেন। যখন দেখে মা ঘর ঝাড়ু দিয়ে ময়লাগুলো যততত্র নিক্ষেপ করছেন; রান্নাঘরের বর্জ্য ঘরের পাশেই ফেলে দিয়ে নাক চেপে ধরে ঘরে ফিরছেন; তখন শিশুরা মনে করছে এটাই বুঝি নিয়ম। তারাও বড় হয়ে একই কাজ করছে হিরোর মতো। খাওয়ার পর কোকের বোতল স্টাইল করে নিক্ষেপ করাও আমাদের সমাজে হিরোইজম হিসেবে দেখা হয়। আজকালকার তরুণ-তরুণীদের ডাস্টবিন দেখে নাক সিটকানো এক ধরনের আধুনিকতা। যদিও ডাস্টবিনের গন্ধ আমাদেরই তৈরি। ঘরে বিড়াল পালা হয়; পাখি পালা হয় কিন্তু একটি ময়লার ঝুড়ি কেনা হয় কদাচিৎ। কারণ পাখি পাললে, ফুলের টব থাকলে নাকি জাতে ওঠা যায়। তাই ময়লার ঝুড়ি ঘরের কোণে বা রান্নাঘরে যথারীতি স্থান পায় না।

শিক্ষালয়ের মেঝে এখন শিক্ষার্থীরা আর ঝাড়ু দেয় না। কারণ তারা এখন হাইপার-শিক্ষায় শিক্ষিত। এতে শিক্ষার্থীর জাত চলে যাবে। তার বাবা অমুক, তার মা অমুক। তাই হাতে ঝাড়ু ধরলে তার জাত থাকবে না। ঝাড়ু ধরবে কেবল দরিদ্রের সন্তানেরা অথবা পেশাগত ঝাড়ুদাররা। নিয়মিত বাড়ি-ঘরের জানালা খোলা ও বন্ধ করার প্র্যাকটিস বেশিরভাগ পরিবারেই আছে বলে আমার মনে হয় না। তাই শিক্ষালয়ে এসেও শ্রেণিকক্ষের জানালা খোলা; বিদ্যুতের সুইচ অফ করার অভ্যাস নেই বললেই চলে। দেখা গেছে এগুলো করলেও নাকি শিক্ষার্থীদের জাত যায়। শিক্ষক কিছু বললে তারা বিড়বিড় করে। অনেকেই বলতে থাকে এই স্যারটা শুধু বকবক করে। অসহ্য, বিরক্তিকর স্যার। অর্থাৎ নেতিবাচকতা, নীতি না মানা, বিশৃঙ্খল জীবন মানেই আধুনিকতা ও জাতে ওঠা। এটাই আজ আমাদের শিক্ষাতে পরিণত হয়েছে।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষালয়গুলোতেই নেই কোনো সেন্ট্রাল ডাস্টবিন। নেই মাইক্রো ডাস্টবিন বা ঝুড়ি; যেগুলোতে শিক্ষার্থীরা তাদের ময়লা, ছেঁড়া কাগজ, মোড়ক ও থু থু ফেলতে পারে। আমি মনে করি, শিক্ষক সমাজেরই পরিবেশ-শিক্ষার ঘাটতি আছে। তারা নিজেরাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চর্চা হতে অনেকটাই দূরে। আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সামাজিক সংস্কৃতি যেহেতু গড়ে ওঠেনি, তখন দুই-চারজন চেষ্টা করেও সফল হচ্ছে না। শিক্ষালয়ের অফিস কক্ষ পরিপাটি করতে আমরা যতটা সচেষ্ট; ক্যাম্পাসের পরিবেশগত স্বাস্থ্য রক্ষা করার ক্ষেত্রে ততটাই বেখেয়াল। কারণ অফিসটা পরিপাটি না হলে পদের সঙ্গে তা যেন বড্ড বেমানান। কিন্তু ক্যাম্পাসে গরু-ছাগলের মল-মুত্র হিহি করে হাসছে তা চোখে পড়ছে না। আবার চোখে পড়লেও অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দায় এড়িয়ে যাচ্ছি। শিক্ষালয়ে যে উন্নয়ন তহবিল আছে, তা থেকেই ক্যাম্পাসের পরিবেশ রক্ষা, বৃক্ষরোপণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজগুলো অনায়াসে করা যায়। কিন্তু সময়ের কোনো এক বাঁকে তহবিল খালি হয়ে যায় কিন্তু শিক্ষা ক্যাম্পাস ঝোঁপঝাড়ে লুটোপুটি খায়। শিক্ষার দ্বারা নীতিবোধের বিকাশ, দেশপ্রেম, বিবেকবোধ জাগ্রত না হলে পরিবেশ-শিক্ষাটাকে বিলাসিতাই মনে হবে। একজন শিক্ষক কোচিং ফি পরিশোধের জন্য শিক্ষার্থীকে যে বকা দেয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য শিক্ষার্থীকে তার ১-৫ ভাগও শিক্ষা দেয় বলে মনে হয় না। শিক্ষাটা পরীক্ষা, জিপিএ-৫ এর নষ্ট জালে আটকা পড়েছে। জাল যদি দৈবক্রমে ছিঁড়ে যায় তবেই রক্ষা।

আরও পড়ুন: সবুজে বেঁচে থাকার লড়াই 

হোটেল-রেস্টুরেন্ট-দোকানের সব আবর্জনা পাশের ড্রেনে নিক্ষেপ করে দোকানি নিস্তার খোঁজেন। আর বৃষ্টিতে ড্রেন উপচে গিয়ে পানি যখন দোকানে বেড়াতে যায়; তখন সরকারকে যা-তা বলে গালি দিতে শুরু করে। এই হলো আমাদের চরিত্র। যদি নিষেধ করা হয় বা বলা হয় ড্রেনে ময়লা ফেলবেন না, তখন দেখতে পাবেন যে আপনার সারা জীবনের শিক্ষা তার নিকট নস্যি। সে যে শিক্ষা আপনাকে দেবে আপনি আর কোনোদিন কাউকে পরামর্শ দেবেন না। একজন বিদেশি কোনো দেশে ভ্রমণের আগে কয়েকটি জিনিস বিবেচনা করেন: পরিবেশ, ক্রাইম রেইট, যোগাযোগ ও সংস্কৃতি। অন্যদিকে বিনিয়োগ নির্ভর করে ব্যবসায় শুরু করতে কয়টি স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়, যোগাযোগের ব্যবস্থা ও পরিবেশগত অবস্থা কেমন তার ওপর নির্ভর করে। সবগুলোতেই আমাদের স্ট্যাটাস তথৈবচ। সিঙ্গাপুরে রাস্তায় একবার থু থু ফেললে তাৎক্ষণিকভাবে ৬৭,০০০ টাকা জরিমানা গুনতে হয়। চীনে এক ডাস্টবিনের ময়লা অন্য ডাস্টবিনে ফেলা মাত্রই ৩০০ আরএমবি জরিমানা গুনতে হয়। আমাদের কোনো ডাস্টবিনের প্রয়োজন হয় না। কারণ পুরো জমিনটাই আমাদের ডাস্টবিন। একজন শিক্ষকের বাথরুম স্বর্গীয় সাজে সাজানো হয় শিক্ষার্থীদের টাকায়; অথচ শিক্ষার্থীরা বাথরুমেই যেতে পারে না। কারণ বদনা নেই, নেই পানি, দুর্গন্ধের কথা না হয় না-ই বললাম। জনগণের টাকায় একজন অফিসার তার বাথরুমের সামগ্রী কেনে ঢাকার সোনারগাঁ রোড থেকে। বিপরীতে তার সেবাগ্রহীতাদের জন্য হয় বাথরুমই নেই অথবা বাথরুমটা তালাবদ্ধ রাখা হয়। কারণ অশিক্ষিত জনগণ বাথরুম ব্যবহার করতে পারে না বলে তারা অভিযোগ করেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এসি মেশিনের যে কদর, জনগণের জন্য ব্যবহৃত বাথরুমটা বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে একই কদর।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এক ধরনের ইবাদত। তাই পরিবারে শৈশবকাল থেকেই সন্তানকে পরিবেশ-শিক্ষাটা হাতে-কলমে, নিজে চর্চা করে শেখাতে হবে। আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকেরা পরিবেশ রক্ষার চর্চা করবে, শিক্ষার্থীদেরও শেখাবে। কারিকুলাম আমাদের পরিবেশের বাস্তবতা বিবেচনা করে তৈরি করতে হবে। তাত্ত্বিক আকারে নয়, বর্ণনামূলক তোতাবুলি নয়, গৎবাধা কথা নয়; আত্মস্থ হতে পারে এমন শিক্ষা কন্টেন্ট তৈরি করতে হবে। আমাদের চারপাশের পরিবেশের উদাহরণ দিয়ে হাতে-কলমে চর্চা করা যায়, এমন পরিবেশ-শিক্ষাই আমাদের দরকার। টেকসই পরিবেশ মানে টেকসই উন্নয়ন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।