হতাশায় দাকোপের তরমুজ চাষিরা
পানির সংকট আর সড়ক যোগাযোগের বেহাল অবস্থার কারণে এবার বাম্পার ফলনের আশা করতে পারছেন না খুলনার দাকোপের তরমুজ চাষিরা। পানির অভাব মেটানোর জন্য সকাল থেকে সেচের মাধ্যমে পানি দিলেও তা খুব বেশি কাজে আসছে না বলে জানা গেছে। চৈত্রের শেষ সময়ে এসেও বৃষ্টি না হওয়ায় চরম হতাশা ভর করেছে কয়েক হাজার চাষির মনে।
এতো কিছুর পরও বেশি লাভবান হওয়ার আশায় এবার তরমুজ চাষে ঝুঁকেছেন অধিকাংশ কৃষক। চালনা পৌরসভাধীন আনন্দনগর, ছোট চালনা, পানখালির মোল্যা বাড়ির কাছে পারচালনা, মান্নানের মোড়, গোলদার বাড়িসহ গ্রামের আশপাশের তরমুজ ক্ষেত দেখে বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে বিভিন্ন সমস্যার কথা জানা গেছে।
বিশেষ করে শহিদুল মোল্যা, কামরুল শেখ, হায়দার শেখ ও খোকন গোলদার বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অনেকে বোরিং করেও তাদের তরমুজ খেতে পানি দিতে পারছেন না। কৃষক-কৃষাণীরা প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত ড্রাম ও পাইপ দিয়ে পানি সংগ্রহ করে তরমুজ ক্ষেতে পানি ছিটানোর কাজে নিয়োজিত থাকছেন। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। পানির অভাবে অনেক কৃষকের ক্ষেতের ফলও তেমন একটা আগের মতো বড় হচ্ছে না।
এই কৃষকরা আরও বলেন, যেটুকু পানি দেয়া হচ্ছে তাতে ক্ষেতে তরমুজের বাগান খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু মাঠে তরমুজ নেই। মূল কারণ মৌমাছি, প্রজাপতিসহ কোনো প্রকার পোকা না থাকায় পরাগায়ন হয়নি তাই ফল ঝরে যাচ্ছে।
মৌমাছি বা কীটপতঙ্গ আসবে কি করে? যে পরিমাণ কীটনাশক ছিটানো হয়েছে তাতে ফুলে বসছে না পতঙ্গ। ফলে পরাগায়ণ হচ্ছে না। অনেকে হাত দিয়ে পরাগায়নের চেষ্টা করলেও তাতে খুব একটা উপকার হচ্ছে না। ফলের হার খুবই কম বলে জানান কৃষকরা।
এদিকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও দুয়েক সপ্তাহের মধ্যে তরমুজ বাজারজাত করার প্রস্তুতি নিয়েছেন দাকোপের কিছু কিছু এলকার কৃষক। কিন্তু সেখানেও সমস্যা দেখা দিয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। দাকোপ এলাকায় উৎপাদিত তরমুজ বিদেশেও রপ্তানি হয়। মৌসুমে ছোট-বড় লক্ষাধিক যানবাহন এসে ভিড় জমায় তরমুজ পরিবহন করার জন্য। কিন্তু ভাঙনের কারণে এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় তরমুজ চাষিরা মহাবিপাকে পড়েছেন।
দাকোপ উপজেলার তিলাডাঙ্গা ইউনিয়নে বছর চারেক আগে অমরেশ গোলদার নামের এক কৃষক তার তিন বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ শুরু করেন। বেশি লাভ হওয়ার কারণে সেই তিলডাঙ্গায় এবার ৭৫ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। কিন্তু চালনা পৌরসভার গোরকাঠি গ্রামের সড়ক পথটি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে এই এলাকায় উৎপাদিত তরমুজ রপ্তানি করা নিয়ে হতাশায় ভুগছেন চাষিরা।
অমরেশ গোলদার বলেন, চার বছর আগে এখানে সর্বপ্রথম তরমুজ উৎপাদন করেছিলাম। তরমুজ বিক্রি করে বেশ লাভও হয়েছিল। সে বছর ৪০ হাজার টাকা খরচ করে তিন বিঘা জমির তরমুজ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করি। আমার দেখাদেখি এবার ৯০ জনের বেশি তরমুজের চাষ করেছেন।
তবে চাষিরা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শেষ থেকে তরমুজ চাষের মৌসুম শুরু হয়। তবে এ বছর মৌসুমের শুরুতেই বৃষ্টি হওয়ায় তরমুজ ক্ষেত ডুবে জমি নরম হয়ে যায়। অনেক চাষি জমিতে কীটনাশক, সার দিয়ে ক্ষেত প্রস্তুত করেন, কিন্তু অসময়ের বৃষ্টিতে তা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মৌসুম শুরু হতে কিছুটা দেরি হয়েছে।
উপজেলার পানখালি এলাকার তরমুজ চাষি পারুল বেগম, মেহেদী হাসান, মোস্তফা বলেন, তাদের জমিতে উৎপাদিত তরমুজের ওজন এরই মধ্যে ২ কেজির বেশি হয়েছে। কিন্তু পানি দিতে না পারায় ফল আর বাড়ছে না।
চাষিরা বলেন, এবার বিঘাপ্রতি তরমুজ উৎপাদনের খরচ হচ্ছে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। ব্যাপক চাহিদার কারণে ইজারা মূল্য প্রতি বিঘা ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে। ডিজেলের দাম বেশি থাকায় চাষের খরচ বেড়েছে, সার সংকট দেখা দিয়েছে, পাশাপাশি বীজের দামও ছিল বাড়তি। আবহাওয়া নিয়েও চিন্তিত কৃষকরা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান খান বলেন, খুলনা জেলার মোট উৎপাদিত তরমুজের ৭০ শতাংশ দাকোপ উপজেলায় উৎপাদিত হয়। গত বছর এ উপজেলায় ৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছিল।
এবছর ৭ হাজার ৬০৫ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। গত বছর এ উপজেলার উৎপাদিত তরমুজ ৫৩৬ কোটি টাকায় বিক্রি হয়। এবার ১ হাজার ১৮৪ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আইলায় কামারখোলা ও সুতারখালী ইউনিয়নের অনেক জায়গায় এবার প্রথমবারের মতো তরমুজের আবাদ হয়েছে।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, গতবার কৃষকরা তরমুজ চাষে ব্যাপক লাভ করেছিলেন। এজন্য এবার অনেকে এক ফসলি বা পতিত জমিতে প্রথমবারের মতো তরমুজ আবাদ করেছেন। আবহাওয়া শেষ পর্যন্ত অনুকূলে থাকলে উৎপাদনও অনেক ভালো হবে। তবে বিপণন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে চাষিরা অনেক লাভবান হবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
খুলনা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনিসুজ্জামান মাসুদ বলেন, চালনা পৌরসভার গোরকাঠি গ্রামের সড়কটি চুনকুড়ি নদীর ভয়াবহ ভাঙনের কারণে সড়কটির ৩০০ মিটার রাস্তা সম্পূর্ণভাবে নদী গর্ভে বিলীন হয়। পরে ওই রাস্তাটির বিপরীত পাশ দিয়ে বিকল্প বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। দাকোপের কৃষকদের উৎপাদিত তরমুজ বাজারজাতে সড়ক পথে ক্ষতি না হয় সে জন্য ওই স্থানের রাস্তাটি শিগগির এইচবিবি হেয়ারবোন দিয়ে তৈরি করা দেওয়া হবে এবং মোংলা ও লাউডোব-বানিশান্তা ফেরিঘাটের রাস্তাটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আলমগীর হান্নান/এমএমএফ/জিকেএস