পেঁয়াজের চারা উৎপাদনে ব্যস্ত পাবনার চাষিরা
অডিও শুনুন
পেঁয়াজের চারা উৎপাদনে এখন ব্যস্ত পাবনার চাষিরা। গত মৌসুমের শেষ দিকে এসে পেঁয়াজের ভালো দাম পেয়েছেন চাষিরা। এছাড়া এবার পেঁয়াজ বীজের দাম গত মৌসুমের তুলনায় অনেক কম। এজন্য পেঁয়াজ চাষে ঝুঁকেছেন চাষিরা।
কৃষি তথ্য সার্ভিস পাবনার আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কুমার সরকার জানান, পাবনা জেলায় এবার (কন্দ ও চারা পেঁয়াজ মিলিয়ে) ৫৩ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পেঁয়াজের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৪৯ হাজার ৩৪ মেট্রিক টন।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। পাবনা জেলাতেই উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন যা মোট উৎপাদনের এক চতুর্থাংশেরও বেশি। আর পাবনা জেলার সাঁথিয়া- সুজানগর উপজেলা থেকে উৎপাদন হয় প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ টন। সে হিসেবে সারাদেশে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের এক পঞ্চমাংশ উৎপাদিত হয় পাবনার এ দুই উপজেলা থেকে।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, জেলার চাষিরা দুটি পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ করেন। এর একটি কন্দ (মূলকাটা বা মুড়ি) অন্যটি চারা (হালি) পদ্ধতি। মূলকাটা পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ শুরু হয় অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ও হালি পদ্ধতিতে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। মূলকাটা পদ্ধতিতে আবাদ করা নতুন পেঁয়াজ ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে হাটে উঠতে শুরু করে। আর হালি পদ্ধতিতে চাষ করা পিঁয়াজ হাটে পাওয়া যায় মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে এপ্রিল মাস পর্যন্ত।
মঙ্গলবার (২৩ নভেম্বর) পাবনার সাঁথিয়া ও সুজানগর উপেজলার বিল গ্যারকাপাড়, বিল গাজনা পাড়, কুমিরগাড়ী, বামনডাঙ্গা, বামনদি, ইসলামপুর প্রভৃতি মাঠে গিয়ে দেখা যায় ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। আমন ধান কাটার পরপরই দ্রুত চাষ দিয়ে জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। চাষি পরিবারের শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ পেঁয়াজের মাঠে কাজ করছে এখন।
বাড়ির নারীরাও পুরুষ সদস্যদের কাজে সহায়তা করছেন। চাষিরা হালি পেঁয়াজ চাষের জন্য ক্ষেত প্রস্তুত করছেন, কেউবা বীজ বপন করছেন আর যারা একটু আগে বীজ বুনেছেন তারা চারা পেঁয়াজের যত্ন পরিচর্যায় ব্যস্ত। চাষির সাথে সাথে জমি চাষ দেয়া ট্রাক্টর মালিকরাও ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সাঁথিয়া উপজেলার কুমিরগাড়ী গ্রামের চাষি আব্দুল খালেক জানান, জমিতে পেঁয়াজ চাষ করতে হলে শুরুতেই পেঁয়াজ বীজ কেনা, চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলা ভাড়া করতে হয়। জমি চাষ সেচ, সার, গোবর, নিড়ানি, শ্রমিক ও উত্তোলন খরচ মিলিয়ে বিঘাপ্রতি প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়।
এর পাশাপাশি যারা অন্যের জমি লিজ নিয় আবাদ করেন তাদের বিঘা প্রতি বাৎসরিক ১০ হাজার টাকা লিজমানি জমি মালিককে দিতে হয়। এজন্য তাদের খরচ হয় আরো বেশি। এছাড়া অনেক ছোট-বড় চাষি চড়া সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েও পেঁয়াজ চাষ করেন। চাষি খালেক জানান, সম্পত্তি তো আর ফেলে রাখতে পারেন না। তাদের পৈত্রিক পেশা কৃষি। তাই অনেক কষ্ট সত্ত্বেও এটা তারা ধরে রেখেছেন।
চাষি আব্দুল কুদ্দুস বলেন, পেঁয়াজ চাষ অনেক পরিশ্রমের কাজ। আবার আবাদ করতেও খরচ বেড়ে গেছে। সার-বিষের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু পেঁয়াজের দাম সে তুলনায় কম। তিনি মৌসুমে পেঁয়াজের নায্য দাম নিশ্চিত করার দাবি জানান। তিনি আক্ষেপের সুরে জানান, সারের দাম বাড়ে, বিষের দাম বাড়ে, তেলের দাম বাড়ে। তখন কোনো আন্দোলন হয় না। কিন্তু পেঁয়াজের দাম একটু বাড়লেই শোরগোল শুরু হয়ে যায়।
পেঁয়াজ চাষের সাথে সম্পৃক্ত পেশার মানুষের ব্যস্ততাও বেড়ে গেছে। কুমিরগাড়ী গ্রামের ট্রাক্টর মালিক আনোয়ার হোসেন জানান, তার এখন চরম ব্যস্ততা। জমি চাষ করার জন্য চাষিদের সিরিয়াল পড়ে গেছে। তিনি জানান, এক চাষ, দুই চাষ ভেদে রেট কম-বেশি আছে। তিনি জানান, ‘দোয়ার চাষ’ (দুই চাষ) দিতে বিঘা প্রতি নিচ্ছেন এক হাজার টাকা। আর ছোট ট্রাক্টর নেয় ছয়শ’ টাকা। আনোয়ার জানান, তিনি প্রতিদিন ১০-১২ বিঘা জমি চাষ করছেন।
পেঁয়াজ বীজতলার চারা রক্ষায় চাষি ছুটছেন সার-বিষের দোকানে। পাবনা শহরে সবচেয়ে বড় সার ও কীটনাশকের দোকানে নর্থ বেঙ্গল ট্রেডার্সে গিয়ে দেখা যায় পেঁয়াজ চাষিদের ভিড়। এখন এ দোকানে আসা বেশির ভাগ চাষিই পেঁয়াজ চাষি বলে জানান দোকানের ম্যানেজার রণজিত কুমার প্রামাণিক।
পেঁয়াজ চাষ প্রধান এলাকা সাঁথিয়ার বিল গ্যারকা পাড়ের চাষি সাগর হোসেন জানান, পেঁয়াজের দাম বাড়লে জমির বার্ষিক লিজমানিও বাড়ে। পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় গ্যারকা বিল পাড়ের জমিতে বাৎসরিক লিজমানি এবছর প্রায় ১৫ হাজার টাকা। এর সাথে রয়েছে উৎপাদন খরচ বিঘা প্রতি ৩০ হাজার টাকা। তারা জানান, এক বিঘায় পেঁয়াজের গড় ফলন হয় ৪০-৫০ মণ।
সে হিসেবে ৬০০ বা ৭০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি করলে চাষির উৎপাদন খরচ ওঠে না। চাষিরা জানান, পেঁয়াজ উৎপাদন খরচই পড়ে যায় মণপ্রতি প্রায় এক হাজার টাকা। মৌসুমে অন্তত দেড় হাজার টাকা মণ দর থাকলে চাষিরা লাভবান হতে পারেন।
সাঁথিয়ার পদ্মবিলা গ্রামের চাষি আব্দুর রশিদ বলেন, তারা অন্যের জমি বাৎসরিক লিজ নিয়ে পেঁয়াজ চাষ করেন। পেঁয়াজ চাষ করে কোনো বছর লাভ আবার কোনো বছর ক্ষতি হয়। তিনি জানান, ক্ষতি হলে বছরে অন্য দুটি ফসল চাষ করে তারা সে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন।
এদিকে বীজ উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় এবছর পেঁয়াজ বীজ গতবারের চেয়ে কমমূল্যে পাওয়া গেছে। এবার ২৫০০-৩০০০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বীজ বিক্রি হয়েছে। গত বছর প্রতিকেজি বীজ ছয়-সাত হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল। এক কেজি বীজের চারা থেকে এক থেকে সোয়া (১.২৫) বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করা যায় বলে চাষিরা জানান।
সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার সঞ্জীব কুমার গোস্বামী জানান, দেশে পেঁয়াজের চাহিদার এক পঞ্চমাংশ পূরণ হয় সাঁথিয়া-বেড়া উপজেলা থেকে। তিনি বলেন, চহিদা বাড়ার সাথে সাথে উৎপাদনও বাড়ছে। উন্নত জাতও উদ্ভাবিত হয়েছে।
তবে সেগুলো দীর্ঘ মেয়াদে পরীক্ষা, নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করতে হয়। চাষি পর্যায়ে পৌঁছাতে সঙ্গত কারণেই সময় লেগে যায়। তিনি জানান, গত মৌসুমের শেষ দিকে এসে চাষিরা ভালো দাম পেয়েছেন। এজন্য চাষিরা পেঁয়াজ চাষে এবার আগ্রহী হয়ে উঠেছ। তিনি জানান, এ অঞ্চলে পেঁয়াজ চাষ কৃষি বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে তাদের ধারণা।
আমিন ইসলাম/এমএমএফ/জিকেএস