রেশম চাষে স্বাবলম্বী কয়েকশ নারী

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক শ্রীপুর (গাজীপুর)
প্রকাশিত: ০২:৩৩ পিএম, ১৩ নভেম্বর ২০২০

রাজধানী ঢাকার পাশেই গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার নিভৃত একটি গ্রাম বড়হর। গ্রামটির অধিকাংশ বাসিন্দার পেশা কৃষিকাজ হলেও সিংহভাগ কৃষকের নিজস্ব কোনো জমি না থাকায় অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এতে সংসারে পুরো বছরই লেগে থাকতো অভাব-অনটন।

কৃষিকাজে জীবনমান উন্নত না হওয়ায় কোনো মতেই ঘুরছিল না তাদের ভাগ্যের চাকা। এমন অবস্থায় কৃষকদের দুর্দশা লাগবে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড। এলাকার নারীদের স্বাবলম্বী করতে তারা রেশম চাষে উদ্বুদ্ধ করেন। সরকারের এমন উদ্যোগে কয়েক বছরেই রেশম চাষ বদলে দিয়েছে গ্রামীণ নারীদের জীবনধারা, আর এই রেশমেই জড়িয়ে গেছে তাদের স্বপ্ন।

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার করিহাতা ইউনিয়নের দিঘিরকান্দা ও রায়েদ ইউনিয়নের বড়হর গ্রামে রেশম চাষ করে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখছে। গ্রাম দুটির বাড়িতে বাড়িতে এখন তৈরি হয়েছে রেশম চাষের পলু ঘর। রেশম চাষের মাধ্যমে দুটো গাঁয়ের নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা আরো অনেককেই আগ্রহী করে তুলছে এই এলাকায়।

GAZIPUR-1

বড়হর গ্রামের জাহেদা আক্তার বলেন, তার স্বামী কৃষিকাজ করেন। সংসারের কাজ শেষে তাকে বাড়িতে অলস সময় কাটাতে হতো। স্বামীর একার সামান্য রোজগারে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ খরচ জোগাতে সমস্যা তৈরি হতো তাদের পরিবারে।

গত পাঁচ বছর আগে তিনি বাড়ির বারান্দায় রেশম চাষ শুরু করেন। এ চাষের মাধ্যমে এখন তো প্রতি বছর তিনি নিজে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা সংসারের জোগান দেন। এতে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখছেন। রেশম চাষ করে সংসারের পুরো খরচ জোগাতে সরকারি সহায়তা বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।

এই গাঁয়েরই বধূ শিল্পী রানী বলেন, তাদের হিন্দুপল্লীতে প্রতিনিয়তই রেশম চাষে ঝুঁকছে নারীরা। সংসারের অলস সময়ে ঘরে বসে একজন নারী হিসেবে বাড়তি আয় করতে পারছেন। আগে নিজের বিভিন্ন খরচের জন্য স্বামীর হাতের দিকে তাকে চেয়ে থাকতে হতো। এখন ঘরে বসেই তিনি আয় করতে পারেন। নিজের ও সন্তানদের খরচ মিটিয়ে স্বামীর হাতেও টাকা তুলে দিতে পারেন তিনি। এভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা তাকে অন্যরকম আনন্দ দেয়।

GAZIPUR-3

দিঘিরকান্দা গ্রামের কামাল হোসেন বলেন, কিছুদিন আগেও অভাবের সংসার ছিল তার। অভাব মোচনে তার স্ত্রী রেশম চাষ শুরু করেন। তিনি মাঠে কাজ করেন আর তার স্ত্রী বাড়িতে রেশম ও গবাদিপশু পালন করেন। এতে কয়েক বছরেই তার সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্র গাজীপুরের অধীন গাজীপুরের কাপাসিয়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় রেশম চাষ হচ্ছে। তাদের দেয়া তথ্য মতে, গাজীপুরের কাপাসিয়ায় হতদরিদ্র পরিবারের নারীদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে এ চাষ শুরু করা হয় বেশ কয়েক বছর আগে।

সমন্বিত প্রকল্পের অধীন রেশম চাষে নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তাদের এই চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে দুটি গ্রামের ৩০ জন নারীর বাড়িতে পলু ঘর নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক বিতরণ করা হয়েছে। রেশম পোকার খাবারের জন্য স্থানীয় সরকারি বরদার খালের উভয় পাশে ৫ কিলোমিটার এলাকায় তুঁত গাছ রোপণ করা হয়েছে। লাভজনক এই রেশম চাষে এলাকার বহু নারী স্বাবলম্বী হওয়ায় অনেকেই এ চাষে যোগ হচ্ছে। এই এলাকায় দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে রেশম চাষ।

GAZIPUR-3

সরকারি এ কর্মসূচির বাইরেও গ্রামের শতাধিক পরিবারের নারীরা রেশম চাষে নিজেদের পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন। তাদের সহায়তায় রেশম বোর্ড থেকে চলতি বছর বাড়ি বাড়ি রোপণের জন্য তুঁত গাছের দেড় হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে।

প্রতিটি বাড়িতে রেশম পোকা বিতরণ থেকে গুটি তৈরি পর্যন্ত সবকিছু তদারকি করে রেশম বোর্ড। পরে উৎপাদিত গুটি কৃষকদের কাছ থেকে কেজি দরে কিনে সুতা উৎপাদন করা হয়।

বছরে চারবার রেশম গুটি উৎপাদন করা যায়। প্রতি বছর ভাদ্র, অগ্রহায়ণ, চৈত্র ও জৈষ্ঠ্য মাসে রেশম গুটি সংগ্রহ করা হয়। কৃষকদের রেশম পোকার ডিম প্রদানের পর কয়েক দিনেই পোকা তৈরি হয়। পরে তুঁত গাছের পাতা কেটে কুচি কুচি করে পোকার খাবার সরবরাহ করা হয়। এভাবে দেড় মাসের মধ্যেই তৈরি হয় গুটি। যেখান থেকে তৈরি হয় রেশম সুতা। বর্তমানে এক কেজি সুতা বিক্রি হয় ৩ হাজার পাঁচশ টাকায়। প্রতি ৭ কেজি গুটি থেকে এক কেজি সুতা উৎপাদন করা যায়।

GAZIPUR-4

গাজীপুরের আঞ্চলিক কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, গ্রামের নারীদের স্বাবলম্বী করতেই রেশম চাষ সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কয়েক বছরেই এ চাষের মাধ্যমে গাজীপুরের কাপাসিয়ার কয়েকশ নারী স্বাবলম্বী হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছেন। নিজ বাড়িতে সংসারের কাজের সাথেই এ চাষে সামান্য সময় দিয়ে সহজেই ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বাড়তি আয় করতে পারেন।

রেশম চাষের মাধ্যমে বিনা খরচে গ্রামের কৃষাণিদের কয়েক মাস পর পর ভালো টাকা আয় রোজগার করতে পারাটাই সরকারের স্বার্থকতা। তিনি আরো জানান, রেশম চাষের প্রধান রশদই হচ্ছে পোকার খাবার তুঁত গাছের পাতা। রেশম পোকার খাবারের সরবরাহের জন্য সরকারি বিভিন্ন খাল ও নদীর ধারে তুঁত গাছ রোপণ করা হচ্ছে। এতে কোনো জমিরও অপচয় হচ্ছে না।

শিহাব খান/এমএমএফ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।