কৃষি ক্ষেত্রে নানামুখী সংকট ও উত্তরণের উপায়
আব্দুর রহিম
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি হচ্ছে অন্যতম ও প্রধান খাত। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৪.১০ শতাংশ। কৃষি কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে দেশজ অর্থনীতি। খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন, শিল্পায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদির মাধ্যমে দেশজ অর্থনীতির ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে কৃষি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষকের দারিদ্র্য, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে জমির স্বল্পতা, উন্নত প্রযুক্তির অভাব, কৃষিকাজে দক্ষতার অভাব, রোগ ও পোকামাকড় আক্রমণ, শস্য গুদামজাতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাব নানা সীমাবদ্ধতার পরেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের রয়েছে ব্যাপক সাফল্য।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে।
এবার টার্গেটের চেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে বলে দাবি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। আমন মৌসুমে টার্গেট ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ টন অথচ উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখ টন। আউশ ধানের টার্গেট ছিল ২৯ লাখ টন, উৎপাদন হয়েছে ৩৫ লাখ টন। বোরো টার্গেট ধরা হয়েছে ১ কোটি ৯৬ লাখ টন, এবার উৎপাদন টার্গেট ছাড়িয়ে যাবে। (সূত্র: ১৬ মে, যুগান্তর)
> আরও পড়ুন- সোনাতলায় বোরো ধান নিয়ে হতাশ কৃষকরা
সম্প্রতি কৃষি খাত চরম সংকটের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। পাকা ধানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কৃষকরা। উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া এর জন্য মুখ্য বিষয়। এক মণ ধান উৎপাদন করতে যেখানে ব্যয় হয় ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকা। অন্যদিকে এক মণ ধানের বিক্রয়মূল্য ৫০০-৬০০ টাকা। একজন কৃষক উৎপাদনের আলোকে ন্যায্য মূল্য না পেলে ব্যাহত হয় তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন। হুমকির মুখে পড়তে হয় ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা থেকে শুরু করে অন্যান্য সব বিষয়ে।
১৮ মে (শনিবার) ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইইডিবি), কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) এবং বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম (বিসিজেএফ) যৌথভাবে আয়োজিত ‘জলবায়ু পরিবর্তন : কৃষি খাতের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘ধানের দাম অস্বাভাবিকভাবে কম হলেও দ্রুত এর সমাধান কঠিন। এ সংকট নিরসনে সীমিত পর্যায়ে চাল রফতানির চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার।’
তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে কৃষিখাত। তবে নানা সমস্যা থাকার পরও বাংলাদেশে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হচ্ছে। মন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে ধান ও গমসহ বার্ষিক উৎপাদন সাড়ে তিন কোটি টন। সরকারের গুদামজাতকরণের ক্ষমতা রয়েছে ২০-২২ লাখ টন। তার মধ্যে গত বছর কেনা ১০ লাখ টনের বেশি ফসল রয়ে গেছে। সুতরাং যতদিন পর্যন্ত কৃষকের কাছ থেকে সব ধান-চাল কিনে মজুদ করা সম্ভব না হয়, ততদিন কৃষককে উপযুক্ত দাম দেওয়া সম্ভব হবে না।’
> আরও পড়ুন- ক্ষতির আশঙ্কায় আগাম ধান কাটছে কৃষকরা
অন্যদিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে গত দেড় মাসে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন চাল। হিলি স্থলবন্দরের বেসরকারি অপারেটর পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের মিডিয়া কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন মল্লিক প্রতাপ জানান, গত এপ্রিল মাসে ভারত থেকে চাল এসেছে ৯ হাজার ১৭৮ মেট্রিক টন। গত ১৫ মে পর্যন্ত এই বন্দর দিয়ে চাল এসেছে ৫ হাজার ২শ’ মেট্রিক টন। তিনি জানান, দিনে গড়ে ৩শ’ মেট্রিক টন চাল ঢুকছে হিলি বন্দর দিয়ে। (সূত্র: ১৮ মে, যুগান্তর)
কৃষি খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যে আমদানি নির্ভরতা কমাতে এবং খাদ্যবহির্ভুত কৃষিপণ্যের উন্নয়নের জন্য যা সবচেয়ে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, তা হলো কৃষি খাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন। এজন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন, তা হলো:
১. বাড়িঘর তৈরি, শিল্প-কারখানা স্থাপন, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ইত্যাদি কারণে দেশে কৃষিজমির পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি কৃষিজমি চলে যাচ্ছে আবাসন প্রকল্পে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বাড়িঘর নির্মাণে। তাই কৃষিজমি অকৃষি খাতে স্থানান্তর বন্ধ করতে হবে।
২. খাদ্যশস্য স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে সার্বিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ বিপর্যয় এড়াতে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে হবে। তাই যত শিগগিরিই সম্ভব তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বণ্টনে চুক্তি সম্পাদনে ভারতকে সম্মত করাতে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এতে সফল না হলে সরকারকে আন্তর্জাতিক ফোরামে যেতে হবে।
> আরও পড়ুন- বৈশাখের আনন্দ নেই বোরো চাষিদের মনে
৩. দেশের উত্তরাঞ্চলে ভূ-উপরিস্থ পানি ধরে রাখার আধারগুলো সংস্কারের মাধ্যমে সেগুলোর ধারণক্ষমতা বাড়ানো গেলে এবং গ্রীষ্মকালে ওই পানি বোরো চাষে ব্যবহার হলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বহুলাংশে কমে যাবে। এতে উত্তরাঞ্চলে বোরো চাষ হ্রাসের ঝুঁকি নেয়ার প্রয়োজনীয়তা এড়ানো সম্ভব হতে পারে।
৪. কৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যেসব বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা উচিত, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন এবং বীজের সঠিক মান নির্ধারণ, উচ্চফলনশীল আলু, ডাল ও শাক-সবজির জাত উদ্ভাবন ও বিতরণ, উন্নত শস্য উৎপাদন প্রযুক্তি কৃষকদের মাঝে সম্প্রসারণ এবং মাঠপর্যায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ। নীতি বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৫. কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দিতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, ‘কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ/গড়বে সোনার বাংলাদেশ’। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিই এদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির পূর্বশর্ত। তাই সরকারের উচিত কৃষি খাতকে বাঁচাতে সুদূরপ্রসারী কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
লেখক: প্রতিনিধি, নোবিপ্রবি।
এসইউ/এমকেএইচ