কাপ্তাই হ্রদ ঘিরে সংকট বাড়ছে
পানি কমায় নৌপরিবহনসহ কাপ্তাই হ্রদ ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা সংকট। সংকট দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু নির্বিকার সরকার। চলতি শুষ্ক মৌসুমে হ্রদের পানি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। যা একেবারে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হ্রদের রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার চেঙ্গী এবং লংগদু উপজেলার কাট্টলী বিল ছাড়া হ্রদের মূল ধারার প্রায় অংশে তলানিতে গেছে পানি। অনেক স্থানে পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়া যায় হ্রদ। হ্রদে অতিরিক্ত পানি কমায় কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদনে মারাত্মক ধস নেমেছে। ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রে বর্তমানে রেশনিং পদ্ধতিতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। হ্রদ দিয়ে বিভিন্ন রুটে বিঘ্ন ঘটছে নৌযান চলাচলে। ব্যাহত হচ্ছে হ্রদ থেকে পানি উত্তোলন ও সরবরাহ নিয়ে।
শুক্রবার কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প ব্যবস্থাপক আবদুর রহমান জানান, হ্রদে পানির স্তর এখন প্রায় সর্বনিম্ন স্তরে। বর্তমানে লেকে পানি রয়েছে ৭৪ দশমিক ৯৮ এমএসএল (মীন সী লেভেল) বা ফুট। ৬৮ ফুট লেভেলে গেলে কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমানে কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে দিনের বেলা কেবল একটি ইউনিট দিয়ে রেশনিং পদ্ধতিতে ৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে। সন্ধ্যায় আরেকটি ইউনিট চালু করে রেশনিং পদ্ধতিতে উৎপাদন চালু রাখা হয়। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থার উন্নতি হবে না বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, হ্রদের উজানে নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি, লংগদু, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইড়ির বিস্তীর্ণ জলাভূমি শুকিয়ে এখন পরিণত হয়েছে মাঠ-প্রান্তরে। হ্রদজুড়ে জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ ডুবোচর। বিভিন্ন অংশে জেগেছে চরাঞ্চল। হ্রদের পানি অস্বাভাবিক হারে নিম্নস্তরে যাওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলায় নৌ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম। ডুবোচরে আটকে যাচ্ছে নৌযান। বেড়েছে নৌপরিবহন সংকট। যাতায়াতে দুর্ভোগে পড়েছেন এলাকার মানুষ।
এদিকে হ্রদে পানি কমায় বর্তমানে লঞ্চসহ যানবাহন চলাচল করছে বিলাইছড়ি রুটে উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার নিচে নতুনবাজার ঘাট, জুরাছড়ি রুটে উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার নিচে সুবলং মিতিঙ্গ্যাছড়ি, বাঘাইছড়ি রুটে উপজেলার সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার নিচে লংগদু উপজেলার ফোরেরমুখ, নানিয়ারচর রুটে ১৫ কিলোমিটার নিচে বুড়িঘাট পর্যন্ত। এছাড়া বরকলের হরিণা রুটে লঞ্চ যাচ্ছে বরকল উপজেলা সদর পর্যন্ত। রাঙ্গামাটি নৌপরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মঈন উদ্দিন সেলিম এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
উল্লেখ্য, কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে ১৯৬০ সালে খরস্রোতা কর্ণফুলি নদীর উপর দিয়ে নির্মিত হয় কাপ্তাই বাঁধ। সৃষ্টির পর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি মৎস্য উৎপাদন, নৌ যোগাযোগ, জলে ভাসা জমিতে কৃষি চাষাবাদ, সেচ, ব্যবহার্য পানি সরবরাহ, পর্যটনসহ বিভিন্ন সুযোগ ও সম্ভাবনা গড়ে ওঠে কাপ্তাই হ্রদ ঘিরে। কিন্তু সৃষ্টির পর গত ৫৭ বছরে কাপ্তাই হ্রদের কোনো সংস্কার, ড্রেজিং বা খনন করা হয়নি। ফলে বছরের পর বছর ধরে নামা পাহাড়ি ঢলে পলি জমে এবং নিক্ষেপ করা হাজার হাজার টন বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে হ্রদের তলদেশ। এতে নাব্যতার সংকটে অস্তিত্বের সম্মুখীন এই হ্রদ। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় হ্রদ ঘিরে তৈরি হয় নানা সংকট।
বিশ্লেষকদের মতে, হ্রদের গতিপ্রবাহ সচল ও নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং জরুরি। এ ব্যাপারে প্রস্তাব দেওয়া হলেও নির্বিকার সরকার।
জেলা প্রশাসক মো. মানজারুল মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, ‘হ্রদের ড্রেজিং না হওয়া পর্যন্ত সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। কাপ্তাই হ্রদের ক্যাপিটাল ড্রেজিং নিয়ে বারবার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নাব্যতা সংকটে দিন দিন কাপ্তাই হ্রদ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। তাছাড়া বর্জ্যে দুষণের শিকার হ্রদের পানি। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে আবারও চিঠি পাঠানো হবে।’
এসইউ/পিআর