ঝিনাইদহে বেড়েছে তামাক চাষ, ঝুঁকিতে প্রাণ-প্রকৃতি

পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির পরও ঝিনাইদহে বেড়েছে তামাক চাষ। বেশি লাভের আশায় তামাক কোম্পানিগুলোর চটকদার প্রলোভনে দিন দিন ক্ষতিকর তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছেন কৃষক। ফলে জেলার শত শত হেক্টর জমি উর্বরতা হারাচ্ছে। উচ্চমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে জমির প্রকৃতিও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তামাক চাষ করা জমিতে অন্য ফসলের ফলন নিয়েও কৃষকদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে।
কৃষকেরা বলছেন, তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অনেক কৃষক রয়েছেন অন্ধকারে। তামাক চাষ রোধে নেই সরকারি দপ্তরের কোনো উদ্যোগ। ফলে তামাক চাষ গত বছরের চেয়ে বেড়েছে। জেলার হরিণাকুণ্ডু, মহেশপুর, সদর উপজেলা ও শৈলকূপার বিভিন্ন মাঠে বিস্তীর্ণ তামাকের ক্ষেত দেখা গেছে। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে নানা সমস্যার কথা।
কৃষকেরা জানান, অন্যান্য ফসল চাষ করলে দাম পাওয়া যায়। কিন্তু ধান, গম, ভুট্টা বিক্রি করে একবারে অনেক টাকা পাওয়া যায় না। যে কারণে কৃষক তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। এ ছাড়া তামাক কোম্পানিগুলো চাষি পর্যায়ে নানা প্রলোভন দেখিয়ে তামাক চাষে আগ্রহী করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কৃষকেরা অভিযোগ করেন, তামাক বিক্রির জন নির্ধারিত কার্ডের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোম্পানির কাছে তামাক বিক্রি করতে হয়। কোম্পানিগুলো কৃষকদের অগ্রিম টাকা-পয়সা দিয়ে অনেকটা জিম্মি করে ফেলে। যে কারণে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে তামাক চাষ করছেন।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামের তামাক চাষি আলী হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘৪ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছিলাম। তামাক এমন একটা জিনিস, যা গরু-ছাগলেও খায় না। নিজের কাছে খারাপ লাগে। আর তামাক চাষ করবো না।’
একই গ্রামের তামাক চাষি আকিমুল হোসেন বলেন, ‘অনেকেই না বুঝে বেশি লাভের আশায় তামাক চাষ করেন। কিন্তু জানতে হবে, প্রতি বিঘা তামাক চাষে খরচ প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা। এ রকম খরচ অন্য ফসলে হয় না। স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, এমন অন্য অর্থকরী ফসল চাষ করতে হবে। আমরাও আগামী বছর তামাক চাষ করবো না।’
কৃষকেরা জানান, গত বছর তামাকের প্রতি কেজি মূল্য নির্ধারণ ছিল ২২৬ টাকা। গুণগত মানভেদে তামাকের কয়েকটি গ্রেড হয়। গ্রেড অনুযায়ী দাম নির্ধারিত হয়। সবচেয়ে ভালো এ গ্রেডের তামাকের প্রতি কেজি মূল্য এ বছরও ২২৬ টাকা চলছে। কোম্পানিগুলো কৌশলে কৃষকদের দিয়ে তামাক চাষ করিয়ে নিচ্ছে। সরকারের ভূমিকা জোরদার করা উচিত।
বেসরকারি তামাক কোম্পানি গ্লোবাল টোব্যাকো লিমিটেডের সুপারভাইজার জাহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘তামাক চাষে কৃষককে বাধ্য করার সুযোগ নেই। লাভের আশায় কৃষক তামাক চাষ করেন। অনেক কৃষক তামাক চাষের জন্য অগ্রিম টাকা-পয়সা নেন। এর বেশি কিছু না।’
সাবেক বিন্নি গোলজার মোড় এলাকার তামাক চাষি মোনতাজ মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ‘তামাক চাষ করে ভুল করেছি। জমির উর্বরতা একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। যে জমিতে একবার তামাক লাগানো হয়; সে জমিতে অন্য ফসল ভালো হতে চায় না। এ ছাড়া তামাক পোড়ানোর গন্ধ ও ধোঁয়ায় স্বাস্থ্য ও পরিবেশ দূষণ হয়। আর এই তামাক চাষ করবো না।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এ বছর জেলায় মোট ২২৯ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে বেশি। গত বছর জেলায় ১৯৩ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছিল। এর মধ্যে কেবল হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় ১৫৫ একর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, তামাকের লাগামহীন চাষ শুরু হলেও এটি রোধে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তৎপরতা নেই। এমনকি সরকারি উদ্যোগে কৃষক পর্যায়ে তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেই। এ নিয়ে সচেতন মহলে অসন্তোষ বাড়ছে।
জেলার কৃষকেরা বলছেন, তামাক চাষ সীমিত করা জরুরি। তামাক চাষ করার কারণে একই জমিতে একাধিক ফসল চাষ করা সম্ভব হয় না। জমির উর্বরতা কমে যায়। পরিবেশ-প্রকৃতির জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ তামাক। গ্রামের পরে গ্রামে কৃত্রিম উপায়ে আগুনের তাপে তামাক শুকানোর ফলে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়া। ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
ঝিনাইদহ সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সাবেক অধ্যক্ষ ও সাংবাদিক আমিনুর রহমান টুকু জাগো নিউজকে বলেন, ‘তামাক একটি ক্ষতিকর উদ্ভিদ। নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হলেও কৃষকের উচিত তামাক চাষ পরিহার করা। তামাকের পরিবর্তে অর্থকরী অন্যান্য ফসল চাষ করা উচিত। পাশাপাশি সরকারকে এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। তামাক চাষ কমাতে পারলে ধূমপান রোধ করা সম্ভব। তামাক কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম্য কমাতে হবে।’
ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ষষ্টি চন্দ্র রায় জাগো নিউজকে বলেন, ‘তামাক চাষ গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ হয়েছে হরিণাকুণ্ডু উপজেলায়। কৃষকদের মাঝে তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করার জন্য সবারই দায়িত্ব রয়েছে। সরকার দ্রুতই এ সংক্রান্ত কর্মসূচি হাতে নিতে যাচ্ছে বলে জেনেছি। আশা করছি, আগামী বছর তামাক চাষ অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারবো।’
এসইউ/জিকেএস