জাটকা বাঁচলেই বাঁচবে ইলিশ

সৈয়দা ফারিভা আখতার
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। ইলিশ মাছ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ। এই মাছ শুধু আমাদের পছন্দের খাবারই নয় বরং হাজারো জেলের জীবিকার মাধ্যমও বটে। ইলিশ শুধু একটি মাছ নয় বরং এটি হলো বাঙালির আবেগ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর অর্থনীতির প্রতীক। কিন্তু এই ইলিশ কি কেবল পাতিলে ওঠা স্বাদের গল্প? নাকি এটি আমাদের নদীর বুকের ঢেউ, মাটির ভেতর লুকানো ঘ্রাণ আর হাজারো জেলের চোখে ভেসে থাকা জীবনের স্বপ্ন?
ইলিশ মাছ আজ শুধু স্বাদের বাহার নয় বরং এটি একটি জীবিকার সমুদ্র। এই মাছের ওপর নির্ভর করে আছে দেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ। বিশেষ করে উপকূল ও নদীবাঁধের জেলেদের জীবন। প্রতিদিন ভোর হলেই জেলেরা নদীতে ছুটে যান। এক টুকরো আশার খোঁজে তারা জাল ভাসান, অপেক্ষা করেন সোনালি স্বপ্ন ধরা পড়বে কি না। তাদের এই ঘামে ভেজা দিন আর নদীর ঢেউয়ের সাথে বাঁধা জীবন সবই জড়িয়ে আছে ইলিশের সাথে। এই ইলিশ শুধু বাজারেই নয় বরং উৎসবেও থাকে। যেমন- নবান্ন, বর্ষা, বৈশাখ ইত্যাদি।
প্রশ্ন হলো, এই ইলিশ এখনো কি আর আগের মতো ধরা পড়ে? না, পড়ে না। নদীর বুকে সেই সোনালি ঝাঁকের ঢেউ আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে কালের ঢেউয়ে। যেখানে একসময় ইলিশের গান বাজতো; সেখানে আজ শুধু শূন্যতা ভেসে বেড়ায়। এই শূন্যতার একটি বড় কারণ হলো জাটকা নিধন।
জাটকা হলো ছোট ইলিশ। সাধারণত ২৫ সেন্টিমিটার বা ১০ ইঞ্চির কম দৈর্ঘের ইলিশকে জাটকা বলে। এরা ডিম দিতে পারে না কিন্তু একটি পূর্ণবয়স্ক ইলিশ বড় হলে গড়ে বিশ লাখ পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। একটি ছোট ইলিশ যদি বেঁচে যায় আর সে যদি বড় হয়ে উঠতে পারে, তাহলে সেই ইলিশ হবে ভবিষ্যতের ইলিশ সম্ভার। কিন্তু বাস্তবে আমরাই সেই সম্ভাবনার সর্বনাশ করি। জাটকা ধরি, বিক্রি করি আবার ভাজি করে খেয়েও ফেলি। এই ছোট্ট ইলিশের বিনিময়ে আমরা হারিয়ে ফেলি ভবিষ্যতের হাজারো ইলিশ মাছ।
জাটকা নিধনের ফলে বিভিন্ন গুরুতর প্রভাব সৃষ্টি হয়। যা আমাদের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সামাজিক অবস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। জাটকা বড় হওয়ার সুযোগ না পেলে ইলিশের প্রজনন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদনও কমে যায়। ইলিশ মাছ কমে গেলে জেলেরা মাছ পান না। এমনকি তাদের আয়ও কমে যায়। পরিবারে অভাব-অনটন বাড়তে থাকে। যে কারণে জেলেদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে।
ইলিশ মাছ রপ্তানি করে বাংলাদেশ ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। কিন্তু যদি ইলিশ মাছ কমে যায়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বেশ প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া ইলিশ অনেক মানুষেরই পছন্দের খাবার। ফলে ইলিশ মাছের উৎপাদন কমলে দাম বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষ ইলিশ মাছ কিনতে পারেন না। তাই এখন যদি জাটকা ধরা বন্ধ না করা হয়, তাহলে এক সময় এমন দিনও আসতে পারে; যখন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইলিশ চিনবে না, এমনকি খেতেও পারবে না।
বিশ্বের মধ্যে উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ ১১তম অবস্থানে আছে। বাংলাদেশে ৮৬ শতাংশ ইলিশ উৎপাদিত হয়। দেশের জিডিপিতে এর অবদান প্রায় ১ শতাংশ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, নদীদূষণ, জাটকা নিধনের কারণে ইলিশের উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাই প্রতি বছর মার্চ বা এপ্রিল মাসে ‘জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ’ পালিত হয়। গত ১ মার্চ থেকে দুই মাসের জন্য জাটকা নিধনের ওপর নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা চলবে। এ সময়ে জাটকা ধরা ও বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
সরকার জাটকা সংরক্ষণের জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন- নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জেলেদের জন্য চাল ও অন্যান্য কাজে সহায়তা করা হচ্ছে। তদারকি বাড়ানো হয়েছে। এমনকি গণসচেতনতা তৈরির জন্য স্কুল, কলেজ, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রচার চালানো হচ্ছে। কিন্তু এ সবকিছুর পরও আমাদের ব্যক্তিগত সচেতনতা না থাকলে এসব উদ্যোগ কখনোই সফল হবে না।
জাটকা নিধন শুধু একটি মাছ ধরার প্রক্রিয়া নয় বরং এটি হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ইলিশের অধিকার হরণ করার প্রক্রিয়া। আমরা সবাই যদি একটু সচেতন হই, তাহলে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তাই জাটকা রক্ষা করা উচিত। ইলিশের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে হবে।
লেখক: অনার্স তৃতীয় বর্ষ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী কলেজ।
এসইউ/জিকেএস