কৃষিতে শৈত্যপ্রবাহের শঙ্কা ও প্রভাব

সমীরণ বিশ্বাস
সমীরণ বিশ্বাস সমীরণ বিশ্বাস , কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
প্রকাশিত: ০৪:০৫ পিএম, ০২ জানুয়ারি ২০২৫

 

ক্রমান্বয়ে শীতের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা ক্রমাগত বাড়ছে। ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং ফলন হ্রাসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফসলের পরাগায়ন ব্যাহত হবে। অতি ঠান্ডায় আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ ইত্যাদি ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যাবে। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় নষ্ট হবে বোরোর বীজতলা। নষ্ট হচ্ছে কৃষকের শিম, লাউ, করলা, মিষ্টি কুমড়া, আলু, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন কৃষি ক্ষেত।

মৌসুমের এ সময়ে মাঠে শীতকালীন ফসল আলু, টমেটো, বেগুন, মরিচ, সরিষা, শিমসহ বিভিন্ন জাতের সবজি আছে। এ ছাড়া কোথাও কোথাও বোরোর বীজতলা আছে। আবার কোথাও বোরো চারা রোপণ করা হয়েছে। চলমান শৈত্যপ্রবাহে বোরো বীজতলা ও রোপা ধানের কোল্ড ইনজুরি এবং আলুর লেট ব্লাইট রোগে আক্রান্ত হওয়ার দুশ্চিন্তায় কৃষক ও মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদরা। এ ধরনের আবহাওয়া গম উৎপাদনে সহায়ক হলেও বৃষ্টি নামলে ছত্রাকবাহী ‘ব্লাস্ট’ রোগের সংক্রমণ ছড়াতে পারে।

এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রা ৯-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে হ্রাস পেয়েছে। ফলে রোপা বোরোর বীজতলা এবং আলু নিয়ে কৃষকের দুশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়ছে। বোরো বীজ রোপণে ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলেও বীজতলা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। পাশাপাশি আলু নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে কৃষকের। অপরদিকে গত কয়েক বছর ছত্রাকবাহী ব্লাস্ট রোগের কারণে সরকার কিছু এলাকায় গম আবাদ নিরুৎসাহিত করলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে বোরোর বীজতলা। বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকনাশক ছিটিয়েও তেমন ফল পাওয়া যাচ্ছে না।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। উত্তরাঞ্চলের তাপমাত্রা তলানিতে নামতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বীজতলা মরে বোরোর চারা সংকট দেখা দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হতে পারে। কৃষকেরা বলছেন, তারা বীজতলায় ছত্রাকনাশক ছিটাচ্ছেন। কুয়াশার হাত থেকে চারা বাঁচাতে বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকেও রাখছেন। তীব্র শীত-কুয়াশার কারণে বোরো নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শীত বেশি হলে বোরো বীজতলায়ও সমস্যা হয়।

শীতে বিশেষ করে কুয়াশা বাড়লে আলুর মড়ক দেখা দেয়। আলু গাছ অতি ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। তাই কুয়াশা ঝরলে চিন্তা হয়। শুধু আলুই নয়; টমেটোর ক্ষেতেও মড়ক দেখা দেয়। কয়েক দিনের ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতে বগুড়া, রাজশাহী ও জয়পুরহাটে আলু চাষিদের মধ্যে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। বিঘার পর বিঘা জমির আলুর পাতা কুঁকড়ে যাওয়াসহ পাতা ও কাণ্ড পচে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। চারদিন পর পর তারা জমিতে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করছেন। আলু রোপণের দেড় থেকে দুই মাস পর কাণ্ড ও পাতা এই রোগে আক্রান্ত হয় বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। লেট ব্লাইট বা মড়ক নামের এই পচন রোগ থেকে রক্ষা পেতে জমিতে সপ্তাহে অন্তত একদিন ছত্রাকনাশক ছিটাতেই হবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

কৃষকেরা বলছেন, কয়েকদিনে রংপুর অঞ্চলে শীতের তীব্রতা বেশ বেড়েছে। দিনের বড় অংশই কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকায় ক্ষেতে ছত্রাকের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় ধানের চারা হলুদাভ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকের বীজতলায় চারা পোড়া ও ঝলসানো রোগও দেখা দিয়েছে। জমিতে ১০-১৫ দিন বয়সী চারাগুলো সাদা ও লালচে রং ধরে মারা যাচ্ছে্। প্রচণ্ড ঠান্ডা ও ঘন কুয়াশার কবল থেকে বোরো ধানের বীজতলার চারা রক্ষার জন্য এখন দরকার: প্রতিদিন সন্ধ্যায় বীজতলা সেচের পানি দিয়ে ডুবিয়ে রাখতে হবে এবং পরদিন সকালে পানি বের করে দিন। চারাগাছে সূর্যের রোদ লাগার ব্যবস্থা করতে হবে। বীজতলায় ২-৫ সেন্টিমিটার (০.৭৮ থেকে ২ ইঞ্চি) পানি রাখুন এবং মাঝে মাঝে জমে থাকা পানি বের করে পুনরায় নতুন পানি দিন।

বোরো ধানের বীজতলা প্রতিদিন সকালে একবার পরিদর্শন করতে হবে। বীজতলার চারা যদি হলুদ হয়ে যায়, তাহলে প্রতি শতাংশ বীজতলার জন্য ২০০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করা দরকার। এতে হলুদ না কমলে প্রতি শতাংশ বীজতলার জন্য ১০০ গ্রাম হারে জিপসাম সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। বীজতলা পাতা ঝলসানো রোগে আক্রান্ত হলে সকালে রশি টানা দিয়ে চারা থেকে কুয়াশার পানি ফেলে দিতে হবে। বীজতলায় প্রতি শতাংশের জন্য ৫০ গ্রাম হারে পটাশ সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

অতিরিক্ত ঠান্ডায় বীজতলায় ছাই ছিটিয়ে তাপমাত্রা ধরে রাখা যায়। কাজেই এ অবস্থায় বীজতলায় ছাই ছিটাতে পারেন। স্বচ্ছ পলিথিন আবৃত ধানের শুকনা বীজতলা তৈরি করা। বীজতলা থেকে চারা তোলার এক সপ্তাহ আগে অনুমোদিত হারে কীটনাশক ছিটাতে পারেন। এতে বীজতলার চারা পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে। বিস্তারিত জানার জন্য আপনার কাছের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সাথে অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগের করুন।

উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলেন, ‘শৈত্যপ্রবাহের সময় বাড়তি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তা না হলে এর প্রভাব সামগ্রিক বোরো উৎপাদনে পড়বে। মাঠপর্যায়ে শৈত্যপ্রবাহের প্রভাব থেকে বাঁচতে বীজতলায় নলকূপের পানি দিয়ে তা ধরে রাখতে হবে। এ ছাড়া বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা যেতে পারে। শিশির পড়লে তা ঝরিয়ে দিতে হবে। এরসঙ্গে ছত্রাকনাশক এবং প্রতি শতক জমিতে ২৮০ গ্রাম করে ইউরিয়া সার দিতে হবে।’

আমাদের মতো দেশে, যেখানে উষ্ণ আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া ও তাপমাত্রার (গরম-শীত) অনাকাঙ্ক্ষিত ঘন ঘন পরিবর্তন বিভিন্ন বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে মাটির জৈব পদার্থ বেশি বিয়োজন হয়। তাই আমাদের মাটিতে সাড়ে তিন পার্সেন্ট জৈব পদার্থ থাকলেও হয়। বর্তমানে আমরা দেখেছি যে, জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ২ শতাংশের নিচে এমনকি কোথাও কোথাও ১ শতাংশের নিচে আছে। মাটির জৈব উপাদানকে মাটির প্রাণ বলে অভিহিত করেন বিজ্ঞানীরা। আবহাওয়ার এই যে ঘন ঘন অতি গরম এবং অতি শৈত্যপ্রবাহ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা, বৃষ্টি-বাদল মাটির প্রাণ জৈবকার্বন শূন্য হওয়ার একটি বড় কারণ বলে মনে করেন পরিবেশ ও মাটি বিশেষজ্ঞরা।

অতিমাত্রায় শীতের পাশাপাশি অসময়ের বৃষ্টিতে কৃষকদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। এই অসময়ের তুমুল বর্ষণে অনেক কৃষক সর্বস্বান্ত হন। সবজি ফসলের চারা পুরোটাই মারা পড়ে। নতুন করে চারা লাগাতে হয়। এরকম দুর্যোগে যদি গাছ টিকে যায় এ আশায়। ফসল চাষে রবি মৌসুম লাভের মৌসুম। বেশ খরচ করে তারা ফসল ফলায় লাভের মুখ দেখবে বলে। সেখানেই অতি শীত এক বড় ধাক্কা।

কুমিল্লা, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং ঢাকার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অসময়ের বৃষ্টি এবং শৈত্যপ্রবাহের শঙ্কায় কৃষকেরা আছেন চরম হতাশায়। জানা যায় তাদের দুঃখ-দুর্দশা, আশা-প্রত্যাশার কথা। মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে কৃষকদের পাশে আছেন। স্থানীয় কৃষি বিভাগ কৃষকদের নিরাপদ ফসল চাষের জন্য সার্বিক পরামর্শ দিচ্ছেন।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।