পাবনায় নিরাপদ সবজি চাষে সফলতার হাতছানি

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি পাবনা
প্রকাশিত: ১২:২৬ পিএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪
নিরাপদ সবজি চাষ পদ্ধতিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন চাষিরা, ছবি: জাগো নিউজ

সবজি চাষে রাসায়নিকের পরিবর্তে জৈব প্রযুক্তির ব্যবহারে সফল হয়েছেন পাবনার কৃষকেরা। এতে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি কমেছে উৎপাদন খরচ। জৈব প্রযুক্তি সম্প্রসারণে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সফলতায় আগামীতে জেলায় সবজি চাষ শতভাগ রাসায়নিকমুক্ত করার প্রত্যাশা কৃষি বিভাগের।

সদর ও আটঘরিয়া উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় উল্লেখযোগ্য হারে শীতকালীন সবজি আবাদ হয়। শিম উৎপাদনে সুখ্যাতি ও প্রাচুর্যের কারণে ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলী গ্রামের পরিচিতি ‘শিম সাগর’ নামে। সদর উপজেলার দাপুনিয়া ও আটঘরিয়া উপজেলার কয়েকটি গ্রামসহ বিভিন্ন উপজেলায়ই কম-বেশি আবাদ হয় শিম ও অন্য সবজি।

সরেজমিনে জানা যায়, অনেক চাষিই শিম চাষে ব্যবহার করছেন জৈব সার। শুধু শিম নয়; ফুলকপি, টমেটো, বেগুনসহ অন্য ফসল চাষেও রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ভার্মি কম্পোস্টসহ নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জৈব সার ব্যবহার করছেন চাষিরা। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ায় গত এক দশকে জেলার এসব অঞ্চলে মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে যায় কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার। এতে উৎপাদিত সবজি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা জানালে রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়ে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ দেয় কৃষি বিভাগ। এগিয়ে আসে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। কারিগরি প্রশিক্ষণে জৈব সার উৎপাদন শিখে তা জমিতে ব্যবহারে কমছে উৎপাদন খরচ। কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব বালাইনাশক ও বিভিন্ন ফাঁদে পোকা দমন কৌশল প্রয়োগ করায় উৎপাদিত হচ্ছে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন নিরাপদ সবজি। নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহযোগিতায় পরীক্ষামূলক প্রকল্পে সফল হওয়ায় এখন রাসায়নিকমুক্ত শিম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এ অঞ্চলের কৃষকেরা।

পাবনায় নিরাপদ সবজি চাষে সফলতার হাতছানি

আটঘরিয়া উপজেলার সবজি চাষি নুরুল জানান, আধুনিক কৃষি পদ্ধতিতে ফলন বাড়ানোর জন্য জমি এখন একটু সময়ও ফেলে রাখা হয় না। একটি সবজি উঠতে না উঠতে আরেকটির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। খুবই অল্প সময়ে নতুন আরেকটি আবাদ শুরু হয়। জমির জো (প্রস্তুতি) আনতে ও দ্রুত আবাদে যেতে অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। ফলন বাড়াতেও এসব ব্যবহার হয়। তাদের জন্মানো সবজি খেয়ে নিজেদেরই রোগবালাই বেড়ে গেছে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণে জানতে পারেন, এর কারণ অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। এ জন্য তারা এখন জৈব সার বেশি ব্যবহার করছেন।

ঈশ্বরদী মুলাডুলির চাষি আসলাম বলেন, ‘আগে আমরা প্রচুর রাসায়নিক সার ব্যবহার করলেও এখন তা করছি না। জৈব সারের ব্যবহার বাড়িয়েছি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ থেকে শেখা পদ্ধতিতে জৈব সার তৈরি করে সেগুলো জমিতে দিচ্ছি। এতে একদিকে আবাদের খরচ কমছে; অন্যদিকে নিরাপদ সবজি উৎপাদন হচ্ছে।’

আরও পড়ুন

আরেক কৃষক আলতাফ মালিথা বলেন, ‘রাসায়নিক সারের জায়গায় জৈব সার আর পোকা দমনের জন্য কীটনাশকের পরিবর্তে ফাঁদসহ বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করছি। এতে আবাদে আমাদের ব্যয় অনেক কমছে। বর্তমানে সংকটের নামে সারের যে দাম বাড়ানো হয়েছে, তাতে নিরাপদ সবজি চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে আমরা লাভবানই হচ্ছি।’

পাবনায় নিরাপদ সবজি চাষে সফলতার হাতছানি

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশার আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক (কৃষি) মো. শামসুদ্দিন বলেন, ‘চাষিরা শুধু উৎপাদন করছেন না, নিজেরাও খাচ্ছেন এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন। অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে ব্যয়ও বাড়ছে। বিষয়গুলো বোঝাতে আশা দীর্ঘদিন কাজ করছে। কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় কৃষকদের নিয়ে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে স্বাস্থ্যকর সবজি ও ফসল উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শুরুতে আগ্রহ কম থাকলেও যখন তারা বিষয়গুলো বুঝতে পেরেছেন; তখন নিরাপদ সবজি চাষ পদ্ধতিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এর মাধ্যমে ব্যয়ও অনেক কমেছে।’

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত জেলায় ৫৩ হাজার ৪০ জন কৃষককে জৈব সার উৎপাদন, কীটনাশক ছাড়া পোকা দমনে ফাঁদ তৈরি এবং এর সঠিক ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১৪ হাজার ৪১০, আটঘরিয়ায় ৬ হাজার ৯০০, ঈশ্বরদীতে ৫ হাজার ৮০৫, চাটমোহরে ৬ হাজার ৫৬০, ভাঙ্গুড়ায় ৩ হাজার ৪২৫, ফরিদপুরে ৩ হাজার ২৯০, বেড়ায় ৬ হাজার ২৮০, সাঁথিয়ায় ১ হাজার ৮৯০ ও সুজানগর উপজেলায় ৪ হাজার ৪৮০ জন কৃষককে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। নভেম্বর পর্যন্ত জেলায় ভার্মি, ট্রাইকো, কুইক কমপোস্ট ও কমপোস্টসহ জৈব সার উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৩১০ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ২৫ হাজার মেট্রিক টনের মতো। অনেক আবাদ বাকি আছে। তা শুরু হলে এ জৈব সার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে বলে জানায় কৃষি বিভাগ।

পাবনায় নিরাপদ সবজি চাষে সফলতার হাতছানি

পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আগে আমাদের লক্ষ্য ছিল খাদ্য নিশ্চিত করা। এখন আমাদের লক্ষ্য নিরাপদ খাদ্য। সেখান থেকেই নিরাপদ পুষ্টিগ্রাম সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে জেলায় সবজি উৎপাদনে রাসায়নিক ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধে কাজ করে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে কৃষকেরা জৈব সার ব্যবহারে ব্যাপক আগ্রহ পাচ্ছেন। প্রতিনিয়ত কৃষকদের সাথে এ নিয়ে আলাপ করছি, প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে নিরাপদ সবজি ও রবিশস্য আবাদে তাদের উদ্বুদ্ধ করছি। খুব শিগগির জেলার শতভাগ কৃষক নিরাপদ সবজি আবাদের আওতায় আসবেন বলে আশা করছি।’

আলমগীর হোসাইন নাবিল/এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।