ক্ষতি পোষাতে ব্যস্ত কৃষক
চাহিদার শীর্ষে সমেষপুরের সবজির চারা
কুমিল্লার বুড়িচংয়ের সমেষপুর সারাদেশের সবজি চাষিদের কাছে পরিচিত। চারা উৎপাদনের কারণে এ গ্রামের ঐতিহ্য ও খ্যাতি অর্ধশত বছরের। ময়নামতি পাহাড়ের পাদদেশে গ্রামটিতে উৎপাদিত হয় বিভিন্ন প্রকার সবজির চারা। প্রতি বছর বেচাকেনা শ্রাবণ মাস থেকে শুরু হলেও সম্প্রতি বন্যা ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে এবার উৎপাদন ও বেচাকেনা শুরু হয়েছে দেরিতে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। পুরোদমে চলছে বেচাকেনা।
সমেষপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রান্তিক চারা চাষিদের কেউ জমি প্রস্তুত করছেন। কেউবা সবজির চারায় পানি ছিটাচ্ছেন। আবার কেউ বিক্রির জন্য তুলছেন চারা। জমির আইলে নতুন চারা সংগ্রহে দাঁড়িয়ে আছেন পাইকাররা। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে তাদের কর্মযজ্ঞ। প্রতিটি জমিতেই কাজ করছেন ২-৪ জন কৃষক। সবুজ-শ্যামল দৃশ্যটি দেখে যে কারো মন জুড়িয়ে যাবে।
কৃষকরা বলছেন, এ বছর বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে চারা উৎপাদনে তারা অন্তত তিন মাস পিছিয়েছেন। এতে অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দেরিতে হলেও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তারা সার্বক্ষণিক কৃষিকাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, সমেষপুরসহ জেলায় প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে ৭ শতাধিক কৃষক চারা উৎপাদন ও বিক্রির কাজে ব্যস্ত আছেন। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৫ হাজারের বেশি মানুষের। প্রায় চার যুগেরও বেশি সময় ধরে বুড়িচং উপজেলার সমেষপুর, ডাকলাপাড়া, কালাকচুয়া কাবিলা ও নিমসারের কৃষকরা চারা উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন।
এ ছাড়া চৌদ্দগ্রাম, চান্দিনা, বরুড়া ও দেবিদ্বারসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এখন চারা উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে। এ বছর প্রায় ২২ কোটি টাকার চারা বিক্রি হওয়ার আশা করা হচ্ছে। কুমিল্লার সবজির চারার মান ভালো এবং ফসল বেশি হওয়ায় দেশব্যাপি চাহিদা তুঙ্গে। কুমিল্লার চারা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, হবিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। বেশি চাহিদায় আছে কাঁচামরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, লাউ ও মিষ্টি কুমড়ার চারা।
সমেষপুর গ্রামের চারা চাষি আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘টমেটো, কাঁচামরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও তাল বেগুনের চারা এরই মধ্যে বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। বাজারে নেওয়ার আগেই পাইকাররা জমির আইল থেকে নিয়ে যাচ্ছেন। বন্যার কারণে এবার আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। সঠিক সময় চারা বসাতে পারিনি। চারা প্রত্যাশী বহু কৃষকের আগ্রহ দেখে দেরি হলেও আমরা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নতুন করে চারা উৎপাদন ও বিক্রি শুরু করেছি। আশা করছি কিছুটা হলেও লোকসান পুষিয়ে নিতে পারবো।’
জেলার লাকসাম উপজেলা থেকে সমেষপুরে চারা কিনতে আসা আবদুল মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানকার সবজির চারা ভালো জাতের। ফলনও ভালো পাওয়া যায়। যার কারণে এত দূরে চারা কিনতে এসেছি। আমি একজন সফল চাষি। প্রতিবার এখান থেকেই চারা নিয়ে চাষাবাদ করি। আশা করছি এবারও ভালো করতে পারবো।’
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার কৃষক তমিজ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর যাবৎ এখান থেকে চারা নিচ্ছেন তিনি। উন্নতমানের চারা ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভালো ফলন পাওয়ায় সব সময় সমেষপুর থেকে চারা নিয়ে যায়।’
সমেষপুরের চারা বিক্রেতা সাথী-বিথী নার্সারির মালিক জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পূর্বপুরুষ থেকে আমরা চারা উৎপাদন করে বিক্রি করি। সর্বপ্রথম আমার বাবা ইউসুফ আলী বিট্রিশ আমলের পর এই গ্রামে চারা লাগান। পরে এলাকায় অন্যদের এ কাজে উৎসাহিত করেন। এখন পুরো এলাকার মানুষ এ ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি ৪০ বছর ধরে চারা উৎপাদন করছি। সমেষপুর ভালো চারার গ্রাম হিসেবে ঐতিহ্য ও সুনাম রয়েছে। গুণগত মান ও ভালো ফলনের নিশ্চয়তায় দেশের অধিকাংশ চাষি আমাদের চারায় আস্থা রাখেন। এ গ্রাম থেকে বছরে অন্তত ৭-১০ কোটি টাকার চারা বিক্রি হয়।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ-পরিচালক আইউব মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সমেষপুরসহ জেলায় প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৭ শতাধিক কৃষক চারা উৎপাদন করছেন। এবার প্রায় ২২ কোটি টাকার বেচাকেনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে চারা উৎপাদনে আমরা সব সময় তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকি। এ ছাড়া এবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।’
এসইউ/এএসএম