বৃষ্টি না হলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কায় চাষিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া
প্রকাশিত: ০৯:২৬ এএম, ০১ মে ২০২৪

বৈশাখ মাসেও উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টির দেখা নাই। চলছে আম, কাঁঠাল, লিচুর মৌসুম। তীব্র গরমে পাবনা, নাটোর অঞ্চলে আম এবং লিচুর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষকেরা জানান, খরার কারণে আম ও লিচুর বোটা শুকিয়ে ঝরে গেছে গুটি।

মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঝড়-বৃষ্টির সময় খরা, আবার খরার সময় বৃষ্টি। আগে বৈশাখের শুরুতে ঝড়ের সাথে বৃষ্টি হতো। এখন বর্ষাকালেও আশানুরূপ বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায় না। আমাদের মতো ক্ষুদ্র কৃষকের পক্ষে প্রকৃতির সহায়তা ছাড়া অতিরিক্ত টাকা খরচ করে আমন ধান চাষাবাদ করা কঠিন।’

জমি ঘুরে দেখা গেছে, মাঠে দুলছে ধান। অধিকাংশ এলাকায় ধানের শীষ পরিপুষ্ট হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মুহূর্তে জমিতে পানি থাকতেই হবে। গাছের গোড়া শুকিয়ে গেলে আর্দ্রতার অভাবে ধান চিটা হয়ে যাবে। ফলে উৎপাদন কমে যাবে।

কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে গেলে ধানে চিটা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেখানে এবার তাপমাত্রা ৩৯-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় ধানে ফুল অবস্থায় পানি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধান গাছের গোড়ায় পানি ধরে রাখা দরকার। সেটা সম্ভব না হলে জমি অবশ্যই ভেজা থাকতে হবে। এ পরিস্থিতিতে তাদের পরামর্শ হলো, ধান, আম, লিচু, কাঁঠাল, জাম, জামরুলসহ ফল গাছের গোড়ায় পানি দেওয়া। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নিশ্চিত করা গেলে রোদের তাপ বাড়লেও ফসলের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না।

এ ছাড়া বেগুন, টমেটো, মরিচ, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা, ঝিঙা, চিচিঙা, পটোল, শসা ও ঢ্যাঁড়শ প্রভৃতি ক্ষেতে তিন-চারদিন অন্তর সেচ দিতে হবে। পাতাজাতীয় সবজি যেমন ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, কলমি, লাউশাক প্রভৃতি ক্ষেতে দুই-তিনদিন অন্তর সেচ দেওয়া প্রয়োজন।

বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রকৃতির এই বৈরী আচরণে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। আমন ধান সম্পূর্ণ বৃষ্টি নির্ভর হওয়ায় সম্পূরক সেচ দিয়ে এ ধানের ফলন ভালো হবে না। ফলে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। দেখা গেছে, মিঠাপুকুর বদরগঞ্জ সড়কের দুইপাশে বিস্তীর্ণ জমিতে ধান ও নানারকম ফসলের মাঠ। এই অঞ্চলে এখন ভুট্টা চাষের চাহিদা বেড়েছে। সড়কের পাশে শতশত বিঘা জমিতে দেখা মিললো ভুট্টার ক্ষেত। তবে তীব্র গরম ও রোদের কারণে এখানকার অনেক জমিই ঝলসে গেছে। পরিপক্ব হওয়ার আগেই পুড়ে গেছে গাছের পাতা ও ফল। হলুদ বিবর্ণ ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে কৃষকের হতাশার চিত্র মিলছে পথে পথে।

কথা হয় কৃষক আবুল হোসেনের সঙ্গে। জানালেন, শরীর ঘামছে সব সময়, কাজ করতে গেলে শরীর দুর্বল লাগে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বৃষ্টি না হলে খরা আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে। এখানকার মাটি আঠালো। পানির অভাবে মাটি শুকিয়ে শক্ত কাঠ হয়ে গেছে।

রাজশাহী বিভাগের পাবনা জেলায় বেশিরভাগ নদী শুকিয়ে গেছে। এরমধ্যে পদ্মা, যমুনা, কাগেশ্বরী, সুতিয়ালী, বান্নাই, চন্দ্রবতী, বড়াল, হুরা সাগর, রত্না, ইছামতি, আত্রাই, গুমানীসহ অনেক নদী রয়েছে। পরিবেশবিদ তুহিন ওয়াদুদ জানান, রংপুর বিভাগেও বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সব নদ-নদীই এখন পানিশূন্য। আগে এসব নদীতে কিছুটা হলেও পানি থাকতো। খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্রের এখন করুণ দশা। হেঁটে চরের ওপর দিয়ে পার হওয়া যায় তিস্তা। বুড়ি তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ফুলপুর, নীলকমল, রতনাই, করতোয়া, রণচণ্ডী, আত্রাই, মহানন্দাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানির প্রবাহ এখন নেই বললেই চলে। অথচ এসব নদীর ওপর ভরসা করেই চলে অনেক কৃষকের জীবন-জীবিকা। আর যমুনেশ্বরী, ঢেপা, ইছামতী, ছোট যমুনা, ঘাঘট, আঁখিরা, হলহলিয়াসহ অন্য নদ-নদীও এখন কোথাও নালা কিংবা খালে রূপ নিয়েছে।

দেখা গেছে, তীব্র খরায় চরাঞ্চলের চিনাবাদাম, তিল, আম ও লিচুসহ বিভিন্ন গাছের ফল শুকিয়ে অসময়ে ঝরে যাচ্ছে। পানির স্তর অস্বাভাবিক ভাবে নিচে নেমে যাওয়ায় নলকূপ থেকেও পানি উঠছে না। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার দীর্ঘ খরায় হুমকির মুখে পড়তে পারে ফসল উৎপাদন। এতে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির পাশাপাশি পরিস্থিতি মোকাবিলা করাই হবে উত্তরের কৃষকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সকাল থেকে তপ্ত হয়ে থাকছে ফসলের মাঠ। মাথার ওপর গনগনে সূর্য প্রকৃতির বুকে আগুন ঢালছে।

বৈশাখের তপ্ত দুপুরে ভুট্টার ক্ষেতের সামনে অপলক দাঁড়িয়ে থাকা মিঠাপুকুরের কৃষক আক্কাস আলী বলেন, ‘এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় ফসল রোপণ করেছি। খরায় চোখের সামনে সেগুলো নষ্ট হচ্ছে। মাটিতে রস নাই। বৃষ্টিও হচ্ছে না। সেজন্য ভুট্টা গাছ থেকে পড়ে যাচ্ছে। মেশিনের পানি দিলে এক নিমিষেই মাটি শুষে নেয়। গাছের কোনো উন্নতি হয় না।’

পাশের সবজি ক্ষেত থেকে হারেজ নামের এক কৃষক বলেন, ‘যে ওষুধ দিচ্ছি, তাতে কাজ হচ্ছে না। ৫০টা বেগুন হলে তারমধ্যে ৪৫টাতেই পোকা। সেচের পানি মাটি ধরে রাখতে পারছে না। তীব্র তাপপ্রবাহে সবজি, ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসলি জমিতে ঘনঘন সেচ দিতে গিয়ে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। পোড়ামাকড়ও বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। সব মিলিয়ে আমাদের দিশেহারা অবস্থা।’

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে উত্তরাঞ্চলে। এবারও বৈশাখের শুরু থেকে চোখ রাঙাচ্ছে সূর্য। তাপমাত্রা ওঠানামা করছে ৩৯-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে। এতে মাঠে ফসল ফলানো নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা।

কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. ইসমাইল হোসেন জানান, ধানের গোড়ায় পানি দিতে হবে। পানির অভাবে ধান চিটা হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এখন চারদিকে রিং টাইপ গর্ত করে পানি দিতে পারলে ভালো। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বালাইনাশক পানিতে মিশিয়ে পরিমাণমতো গাছের পাতায় ছিটানো গেলে কিছুটা হলেও রক্ষা হবে।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।