বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের ভূমিকা

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৪৭ পিএম, ২৯ অক্টোবর ২০২৩

রত্না খাতুন

পাট প্রাকৃতিক আঁশ। পাটের আঁশ পট, কোষ্টা ও নলিতা নামে পরিচিত। এটি সব প্রাকৃতিক আঁশ বা তন্তু অথবা ফাইবারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সস্তা, শক্তিশালী ফাইবার হিসেবে বিবেচিত। পাট গাছের ছাল থেকে পাটের আঁশ সংগ্রহ করা হয়। বিশ্বে বাণিজ্যিক তন্তুর মধ্যে এবং টেক্সটাইল ফাইবার উৎপাদনে তুলার পরেই পাটের স্থান। পাট সেলুলোজ, লিগনিন, হেমি-সেলুলোজ, মোম, পেকটিন, প্রোটিন এবং খনিজ পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত একটি লিগনোসেলুলোজিক মাল্টি-সেলুলার ফাইবার। বিশ্বে মোট ১৮.৮৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় এবং ৩২ লাখ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদন ১ হাজার ৬৫৬ কেজি। পাট উৎপাদনে বিশ্বে এশিয়া মহাদেশই প্রথম। বিশ্বে ৯৫ শতাংশ পাট এশিয়ায় জন্মে।

বাংলাদেশ পাট উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। উৎপাদনের পরিমাণ ১৩ লাখ ৩৫ হাজার টন, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৪২ শতাংশ। পাট বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশে প্রায় ৭.০-৮.০ লাখ হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদিত হয় এবং এই চাষে প্রায় ৩.০-৩.৫ মিলিয়ন কৃষক জড়িত আছেন। আমাদের দেশে পাটকে সোনালি আঁশও বলা হয়। কারণ পাটের আঁশের রং সোনালি এবং বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ২৫ শতাংশ আসে পাট থেকে।

২৫ শতাংশ পাটে আমাদের চাহিদা পূরণের পর ৬০ শতাংশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং ১৫ শতাংশ ভারতে রপ্তানি করা হয়। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, বিগত ১২ বছরে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে চারবার। প্রথমবার ২০১০-২০১১ অর্থবছরে ১১১.৪৯ কোটি মার্কিন ডলার, দ্বিতীয়বার ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে ১০৩.০৬ কোটি মার্কিন ডলার, তৃতীয়বার ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ১০২.৫৫ কোটি মার্কিন ডলার। জুটইয়ার্ন এবং টোয়াইন রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে। পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১১৬.১৪ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় হয়। কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে ১৩.৮১ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের (২০১৭-২০১৮ অর্থবছর) চেয়ে ৬% বেশি।

আরও পড়ুন: কৃষি বিপ্লবের স্বপ্নসারথীদের সাফল্যগাথা

কিছুদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, বর্তমানে পাট খাতের বৈশ্বিক রপ্তানি আয়ের ৭২ শতাংশ এখন বাংলাদেশের। মন্ত্রী বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে কেবল ব্যাগের চাহিদা ১০ কোটি থেকে ৭০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে এবং অন্যান্য পাটপণ্যের চাহিদা আছে প্রায় হাজার কোটি টাকার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সূত্রে তিনি বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি করে প্রায় ১১৩ কোটি মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। পাটের প্রাথমিক বাজারমূল্য বাবদ ৫০০০-৬০০০ কোটি টাকা দেশের রবি ফসলের পুঁজির জোগান দেয়।

পাট থেকে বিভিন্ন প্রকার পাটজাত পণ্য উৎপাদন হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে পাট দিয়ে ২৮৫ ধরনের পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। পাটজাত পণ্য সব সময়ই পরিবেশবান্ধব। ইউরোপের ২৮টি দেশসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ প্ল্যাস্টিক নিষিদ্ধ করেছে। কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে, পলিথিন ব্যবহারের ফলে শুধু মানুষই না প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা ইকোসিস্টেম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাছাড়া পলিথিন অপচনশীল হওয়ায় তা মাটির উর্বরতা হ্রাস করে। শহরের ড্রেনেজ সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং পোড়ালে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সৃষ্টি করে। ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি হয় সোনালি ব্যাগ। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পচনশীল এ সোনালি ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই যার চাহিদা দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।

টেকসই, পরিবেশবান্ধব সবুজ উন্নয়নের লক্ষ্যে পলিথিন ও সিনথেটিকের ব্যবহারের পরিবর্তে পাটপণ্যের ওপর ঝুঁকে পড়ছে বিশ্ব। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায়, এক বিঘা জমির পাট থেকে ২৭ টন অক্সিজেন তৈরি হয়। পাটকাঠি পুড়িয়ে যে ছাই তৈরি হয় তা ব্যাটারি, ওষুধ, প্রসাধনীতে ব্যবহৃত হয়। পাট দ্বারা চট, বস্তা, পলিথিন ছাড়াও চোখ ধাঁধানো শোপিস, চেয়ার, দরজা, ফুলদানি, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, স্যুট-প্যান্ট, চাদর, পর্দা, কার্পেট, জায়নামাজ, ত্রিপল, গালিচা, গদি, শিঁকা, কাগজ, পারটেক্স, হার্ডবোর্ড প্রভৃতি তৈরি হয়। এমনকি ডেনিমও পাট থেকে তৈরি হয়। এসব পণ্য যেমন সৌন্দর্যবর্ধক; তেমনই শতভাগ পরিবেশবান্ধব এবং দামও সাধ্যের মধ্যে। ফলস্বরূপ এসবের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে বিশ্ববাজারের ক্রেতাদের।

আরও পড়ুন: পাট চাষে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধির সম্ভাবনা

কাঁচাপাট রপ্তানিতে অনেকদিন থেকেই শীর্ষস্থান বাংলাদেশের দখলে। ফলে পাটশিল্প দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করে তুলছে। ২০১১ সালে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ১৫ হাজার অংশগ্রহণকারীর হাতে যে আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাটের ব্যাগ তুলে দেওয়া হয়েছিল; সেগুলো গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকেই। গাড়ির কাঁচামাল হিসেবেও বাংলাদেশের পাটের কদর রয়েছে। বর্তমানে নামিদামি গাড়ি তৈরির কোম্পানিও পাট ব্যবহার করছে। জার্মানির বিএমডব্লিউ কোম্পানির সর্বাধুনিক ইলেকট্রিক গাড়ির ভেতরে বক্স বডি ও এর উপাদান তৈরির কাঁচামাল হিসেবে পাট ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া পাট থেকে তৈরি হয় ভিসকস সুতা, যা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করতে পারলে আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের সুতার চাহিদা মেটানো সম্ভব। ফলে আমদানি ব্যয় কমবে।

লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সাইটোজেনেটিক্স শাখা, জিআরএসডি, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।