যেভাবে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির উদ্যোক্তা হলেন তাহেরা রেজা

বেনজির আবরার
বেনজির আবরার বেনজির আবরার , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০৮:২৫ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির উদ্যোক্তা তাহেরা রেজা। তাহেরা এগ্রো এন্টারপ্রাইজ দিয়ে তার উদ্যোক্তা জীবন শুরু হয়। পরে তাহেরা মৎস্য খামার, হাইড্রোপনিক্স ডটকম ডটবিডি এবং ড্রিপ ইরিগেশন বিডি লিমিটেডের মতো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেছেন এ নারী উদ্যোক্তা। সম্প্রতি তার উদ্যোগ ও সফলতা নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বেনজির আবরার—

জাগো নিউজ: আপনার শৈশব, পড়াশোনা ও পরিবার সম্পর্কে যদি বলতেন—
তাহেরা রেজা: আমি ১৯৯৩ সালে সাতক্ষীরার এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করি। বাংলাদেশের গ্রামের সাধারণ দশটা মেয়ের মতো আমার শৈশব কেটেছে কৃষক পরিবারে। প্রথম জীবনে সিদ্ধেশ্বরী গার্লসে ভর্তি হলেও সেখানে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারিনি। সাতক্ষীরার স্থানীয় মাদ্রাসা ও কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করি। শিক্ষাজীবনে বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের ওপর স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছি।

আমার কর্মজীবনে সাফল্যের পেছনে পরিবারের সদস্যদের অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। আমার বাবা মো. আবু বকর সরদার একজন সফল কৃষক ও কৃষি ব্যবসায়ী। শৈশব শেষে তিনি আমাকে ব্যবসা শেখার সুযোগ দেন। আমি পারিবারিক ব্যবসা দেখার পাশাপাশি ব্যবসা শিখে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাহেরা এগ্রো এন্টারপ্রাইজের দায়িত্ব গ্রহণ করি। পরে তাহেরা মৎস্য খামার, হাইড্রোপনিক্স ডটকম ডটবিডি এবং ড্রিপ ইরিগেশন বিডি লিমিটেডের মতো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেছি। পারিবারিক জীবনে আমি স্বামী, ছেলে ও মেয়ে নিয়ে বসবাস করছি।

আরও পড়ুন: পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের এক নতুন সাফল্য

জাগো নিউজ: ড্রিপ ইরিগেশন বিডি প্রতিষ্ঠার চিন্তা কিভাবে মাথায় এলো?
তাহেরা রেজা: আমার জেলা সাতক্ষীরা, সাগরের খুব কাছে হলেও এখানে চাষযোগ্য মিষ্টি পানির অভাব চরম পর্যায়ে। এলাকার সব খালে মিষ্টি পানির পরিবর্তে নোনা পানি। ফলে এ পানি ফসলের মাঠে ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। বাবার কৃষিকাজ থেকে দেখেছি, পানি থাকতেও কিভাবে পানির অভাবে চাষাবাদ হচ্ছে না। খুব ছোটবেলা থেকে দেখছি সাতক্ষীরায় মাঠ ফসলের পাশাপাশি ফলের চাষ অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে আম এবং লিচু বাগান আছে আমাদের। এসব বাগানের ফলন সম্পূর্ণ পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। বৃষ্টি না হলে কোনো ফসলই ভালো হয় না। আবার যে বছর বৃষ্টি ভালো হয়, সে বছর ঝড়-বৃষ্টিও বেশি হয়। এক কথায় বলতে গেলে, কৃষক প্রতি বছরই ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

এর কোনো সমাধান আমার কাছে ছিল না। আমার বিয়ে হয় একজন কৃষিবিদের সঙ্গে। তার সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে জানতে পারি, খুব অল্প পানি ব্যবহার করে সেচের আধুনিক পদ্ধতি আছে। যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের কৃষকরা ব্যবহার করেন না। ঠিক সে মুহূর্তে খরচের কথা চিন্তা না করে এ প্রযুক্তি আনার চেষ্টা করি। পাইলট প্রকল্প হিসেবে স্থানীয় বাগানে স্থাপন করি। চমৎকার ফলাফল পাই। স্থাপন করি মায়ের ছাদ বাগানে। সেখানেও ভালো ফলাফল পাই। সমস্যা একটাই, যে খরচ হয়েছে তা কৃষকদের জন্য একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব ছিল। তবে হাল ছাড়িনি। স্বামী এবং তার বন্ধুমহলের সঙ্গে আলাপ করি, কিভাবে খরচ কমানো যায়?

একাধিকবার চেষ্টা করে কয়েকজনকে পেয়ে যাই। শুরু হয় নতুন গবেষণা। কিভাবে এ প্রযুক্তি বাংলাদেশের কৃষকের জন্য সহজলভ্য করা যায়? ইসরাইল, চায়না, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তি নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু হয়। বিদেশি প্রযুক্তি থেকে বাদ দেওয়া হয় অপ্রয়োজনীয় সব উপাদান। সংযোজন করা হয় দেশীয় কিছু প্রযুক্তি। দেশেই তৈরি করা হয় বেশকিছু যন্ত্রাংশ। সব মিলিয়ে প্রায় তিনগুণ খরচ কমিয়ে আনতে পেরেছিলাম! এরপর বিভিন্ন খামারে এবং মেলায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করি। চলতে থাকে রাত জেগে অনলাইনে সচেতনতামূলক পোস্ট লেখা। এ প্রযুক্তির ফেসবুক পোস্ট লাখো মানুষের কাছে অর্গানিকভাবে পৌঁছে যায়। আধুনিক প্রজন্মের তরুণ কৃষকরা শেয়ার করতে থাকেন। এভাবে একজনের কাছ থেকে দশজনের কাছে পৌঁছায়।

আরও পড়ুন: বারোমাসি ‘কাটিমন’ আম চাষে সফল শামিম

অনেক কৃষকের মেসেজ এবং কল পাই। সবকিছু একদিনে হয়নি, সময় লেগেছিল প্রায় দুই বছর। কোনো লাভ কিংবা আয় ছাড়া এতগুলো লোক কাজ করে যাচ্ছে দিনের পর দিন! সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো এগিয়ে যাচ্ছিল। তবে খুব বেশি কৃষকের মাঠে পৌঁছাতে পারেনি। এর জন্য প্রয়োজন ছিল অনেক উপকরণের। এ প্রযুক্তি বাস্তবায়নের জন্য টিমের সদস্যদের অনেক বেশি সময় দেওয়ার জন্য নিজস্ব পেশা ছেড়ে আসতে হয়েছে। নেশা থেকে পেশায় রূপান্তর হয় এ কার্যক্রম। প্রায় পাঁচ জনের একটি দল চালাতে অনেক খরচ হতো। ২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ড্রিপ ইরিগেশন বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন পাই আমি।

জাগো নিউজ: আপনাদের এই ড্রিপ ইরিগেশন প্রযুক্তি কী এবং কিভাবে কাজ করে?
তাহেরা রেজা: ড্রিপ ইরিগেশন প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা প্রতিটি গাছের গোড়ায় গোড়ায় পাইপ নেটওয়ার্কিং করে থাকি এবং যে গাছের জন্য যতটুকু পানি দরকার; ঠিক ততটুকু পানি এবং সার শুধুমাত্র গাছের শিকড়ে দিয়ে থাকি। যার ব্যবহারে কৃষকের ৭০% পানি এবং ৬০% সার সাশ্রয় হয়। এর পাশাপাশি ফসলের মাঠে বাড়তি আগাছা হয় না। কৃষকের ৬০% খরচ কমে যায় এবং পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ অটোমেটিক হাওয়ায় ৭৫% সময় কম লাগে। এছাড়া এ পদ্ধতিতে ২০ থেকে ২৫ ভাগ ফলন বৃদ্ধি পায়। প্রযুক্তি সেটাপের প্রাথমিক খরচ একটু বেশি হলেও একবার স্থাপনে প্রায় ৮ থেকে ১০ বছর স্থায়ী হয়। যা একজন শ্রমিক বা উদ্যোক্তা নিজেই খুব সহজে ম্যানেজ করতে পারেন। ড্রিপ ইরিগেশন ছাড়াও গাছে পানি দেওয়ার জন্য স্প্রিংকলার ইরিগেশন ও ফগিং ইরিগেশন প্রযুক্তি কৃষকের মাঠে ব্যবহার করছি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও ফসলভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

জাগো নিউজ: বর্তমানে কতজন আপনার এই স্বপ্ন-উদ্যোগে কাজ করছেন?
তাহেরা রেজা: প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধীরে ধীরে আমাদের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। দুই বছর পর বর্তমানে এখন আমাদের টিমে প্রায় ২০ জন স্থায়ী সদস্য এবং ৫০ জনের মতো স্থানীয় প্রশিক্ষিত টেকনিক্যাল জনবল আছে। দেশব্যাপী চারটি শাখা আছে। সব মিলিয়ে কৃষকদের সেবা প্রদানের জন্য কৃষিবিদ, কৃষি প্রকৌশলী, যন্ত্র প্রকৌশলী, আইওটি ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী জনবল নিয়ে একটি শক্তিশালী টিম তৈরি হয়েছে। এখন প্রায় সারাদেশে কাজ চলছে। তবে বাংলাদেশের কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতার কথা বিবেচনা করে অতি অল্প মুনাফায় এত বড় একটি টিম চালিয়ে নিতে খুবই কষ্ট হয়। বিশেষ করে বর্ষার সময় কাজ প্রায় বন্ধই থাকে। করোনাকালীন আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বেশ কিছু আমদানি নির্ভর পণ্য না থাকায় কোম্পানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় যায় অবস্থা। টিমের বেশ কিছু সদস্যকে আমরা হারিয়েছি। তবে কৃষকরা আমাদের কখনো ছেড়ে যাননি। তারা সব সময় আমাদের পাশে ছিলেন। এ ক্রান্তিকাল মোকাবিলা করতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে এবং শিক্ষাও হয়েছে।

আরও পড়ুন: ১৫ হাজার গাছের চারা রোপণ ও বিতরণ করেছেন আরাফাত

জাগো নিউজ: এমন উদ্যোগ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
তাহেরা রেজা: করোনাকালীন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে আমরা আর কখনো দুঃস্বপ্ন দেখিনি। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছি। করোনাকালীন যেসব পণ্য আমদানি করতে পারিনি; সেসব পণ্য এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে। আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। তবে এখনো অন্যের কারখানায় উৎপাদনের কাজ চলছে। ফলে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশা করি খুব শিগগির নিজস্ব কারখানা স্থাপন করবো। এ প্রযুক্তির খরচ আরও কমিয়ে আনবো।

এর সঙ্গে এ প্রযুক্তিকে আরও উন্নত এবং অটোমেটিক করতে আমাদের হাতে এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আইওটি ভিত্তিক প্রযুক্তি আছে। যার মাধ্যমে একজন কৃষক তার হাতে থাকা স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে মাঠের ফসলের অবস্থা বলতে পারবেন। এ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্র্যান্ট (বিগ) ২০২৩-এর গ্র্যান্ট উইনার সেরা ৫২-এর তালিকায় আমাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ প্রাপ্তি আমাদের আরও একধাপ এগিয়ে দিয়েছে।

বর্তমানে ঢাকা, যশোর, চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় শাখা আছে। এভাবে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে শাখা স্থাপন করার পরিকল্পনা চলমান। এছাড়া কেন্দ্রীয় গবেষণা টিম ও শক্তিশালী সার্ভিস টিমের পাশাপাশি ফ্রান্সাইজ মডেলে প্রতিটি জেলায় প্রতিনিধি থাকবেন। ফলে কৃষকরা খুব সহজে কাছাকাছি মানুষের কাছ থেকে দক্ষ সেবা নিতে পারবেন। এ প্রযুক্তিকে কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াই একমাত্র লক্ষ্য। এভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য স্মার্ট কৃষক তৈরিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।