তীব্র গরমে কৃষিখাতে বিপর্যয়ের শঙ্কা ও করণীয়

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:২৯ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০২৩

সমীরণ বিশ্বাস
তীব্র তাপদাহে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের কৃষি খাত। দিন দিন দেশব্যাপী তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। যেখানে ৩৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা ধানের জন্য অসহনীয়, দেশে চলছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা! যা সার্বিক ধান উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় অন্তরায়! এই অতি তাপদাহে ধান ছাড়াও আম, কাঠাল, লিচু ও তুলাসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। ভুট্টা ও সোয়াবিন উৎপাদনেও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ পর্যন্ত চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ এবং বিগত ৫৮ বছরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এই তাপমাত্রা সার্বিক কৃষির জন্যই অসহনীয়! এ বৎসর অস্বাভাবিক গরম পড়ছে। বাতাসের আদ্রতার পরিমাণ খুবই কম। অতি খড়া, অতি উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ফসলের উৎপাদন ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরইমধ্যে কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন বৈরী আবহাওয়ায় কীভাবে ভালো ফসল উৎপাদন করা যায় তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। অন্যদিকে গাছপালা উজার করে সবুজ আচ্ছাদন হারিয়ে নগরায়ন ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে। এই তাপদাহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও দায়ী বলে মনে করেন গবেষকরা। এছাড়া সারা দেশের পুকুর, খাল-বিল জলাশয় অপরিকল্পিত ভাবে ভরাট এবং দখলের মহাউৎসব চলেছে- যার বৈরীতা তাপদাহের সঙ্গে প্রভাব ফেলেছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেশে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপ প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং এ তীব্র তাপদাহ ১০ই এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে। এই সময় বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা নাই। ফসলের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে-

ধান ফসলের ব্যবস্থাপনা
বোরো ধানে হিটশক (তাপ জনিত ক্ষতি) বা গরম বাতাস (৩৫ ডিগ্রী) প্রবাহ হলে ধান চিটা হতে পারে। তাই জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি, কাইচথোর হতে ফুল ফোটা পর্যায় পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে। ধান গাছের ফুল অবস্থায় সাতটা থেকে এগারোটা পরাগায়নের সময়, এই সময় কোন প্রকার বালাইনাশক স্প্রে করা যাবে না। ধান যাতে চিটা না হয় সেজন্য এমওপি সার দশ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম মিশিয়ে ৫ শতাংশ হিসাবে স্প্রে করা যেতে পারে। তাপ প্রবাহের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য জলবায়ু সহনশীল তাপ প্রতিরোধী নতুন ধানের জাত ব্রি৮৯ এবং ব্রি ৯২ জাতের ধান চাষ করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন: তীব্র গরমে মৎস্য খামারিদের করণীয়

ফল-ফসলের ব্যবস্থাপনা
আম, কাঠাল এবং লিচু গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত (৭ থেকে ১০ দিন অন্তর) সেচ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে গাছের শাখা-প্রশাখায় পানি স্প্রে করে দিতে হবে। প্রয়োজনে প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া যেতে পারে। এতে ফল ঝরে পড়া কমবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া মাটিতে রস ধরে রাখার জন্য সেচের পর গাছের গোড়ায় মালচিং দেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ধরনের বস্তু দিয়ে যখন গাছপালার গোড়া, সবজি ক্ষেত ও বাগানের বেডের জমি বিশেষ পদ্ধতিতে ঢেকে দেওয়া হয় তখন তাকে বলে মালচ। আর এ পদ্ধতিটি কে বলে মালচিং।

ফসলের ক্ষেতে আর্দ্রতা সংরক্ষণে মালচিং বিশেষভাবে উপকারী, কারণ এ প্রযুক্তি ব্যবহারে ফসল ক্ষেতের পানি সূর্যের তাপ ও বাতাসে দ্রুত উড়ে যায় না। ফলে জমিতে রসের ঘাটতি হয় না এবং সেচ লাগে অনেক কম। মালচিং ব্যবহার করলে জমিতে প্রায় ১০ থেকে ২৫ ভাগ আর্দ্রতা সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।

সবজি ফসলের ব্যবস্থাপনা
ফল এবং পাতা জাতীয় সবজির জমিতে আগামী এক সপ্তাহে মাটির ধরন বুঝে প্রয়োজনীয় দুই থেকে তিনটি সেচ ব্যবস্থা করতে হবে। জৈব সারের পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি, সেজন্য জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। ফল এবং সবজির চারা কে তাপ প্রবাহের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য মালচিং ও সেচ নিশ্চিত করতে হবে। চলমান তাপ প্রবাহের কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিতে হবে।

প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনা
প্রাণিসম্পদের তাপ প্রবাহ জনিত পীড়ন (স্ট্রেস) সহনশীল করতে, গবাদিপশু, পোলট্রির ঘর শীতল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। গবাদি প্রাণীকে দিনে একাধিকবার গোসল করিয়ে দিতে হবে অথবা পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। গবাদিপশুকে পানির সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ, ভিটামিন সি এবং গ্লোকোজ ইত্যাদি মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। তাপদাহের এই সময় গবাদি পশুকে ঘরে আবদ্ধ না রেখে গাছের বা প্রাকৃতিক ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। গবাদিপশুকে এই সময় শুকনো খড় না দিয়ে কচি সবুজ ঘাস খেতে দিতে হবে। অতি তাপদাহে খাবার কমিয়ে দিতে হবে। প্রচন্ড গরমের সময় গবাদি পশুকে কৃমিনাশক, টিকা কিংবা প্রাণীর পরিবহন পরিহার করতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি হলে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

মৎস-সম্পদ বাঁচাতে ব্যবস্থাপনা
তুলনামূলক কম গভীরতার পুকুরে নতুন পানি যোগ করে গভীরতা কমপক্ষে ৫ ফুট করতে হবে যাতে নিচের পানি কিছু ঠান্ডা থাকে এবং মাছ সেখানে থাকতে পারে। পুকরের দক্ষিণ পাড়ে পানির মধ্যে মাঁচা করে লাউ জাতীয় গাছ লাগিয়ে পুকুরে ছাঁয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পুকুরের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ জায়গায় চারদিকে বাঁশের ঘেরাও দিয়ে কচুরি পানা/ নারকেল গাছের পাতা রাখা যেতে পারে। দিনের বেলায় রোদের সময় অর্থাৎ দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গভীর নলকূপ থেকে পানির সরবরাহ করে কমপক্ষে ৫ ফুট বা তার বেশি পানির উচ্চতা বজায় রাখতে হবে। সকালে শতকে ২০০-২৫০ গ্রাম লবণ বা ১০০ গ্রাম ভেট স্যালাইন গুলিয়ে পুকুরে ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। রাতের বেলায় এরেটর/ব্লোয়ার/মেশিন (পুকুরের পানিকে ফোয়ারা বা ঘূর্ণি তৈরি করে বাতাসের অক্সিজেনকে পানিতে দ্রুত মিশাতে সহায়তা করে) চালিয়ে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে অন্যথায় শতকে ১০ গ্রাম হারে অক্সিজেন ট্যাবলেট পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরের পানি স্বাভাবিক ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত পুকুরে খাবার সরবরাহ কমিয়ে দিতে হবে, বা প্রয়োজনে সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে। সকাল এবং সন্ধ্যার পর খাবার অল্প করে দিতে হবে। ভিটামিন-সি মিশিয়ে (৭-৮ গ্রাম/কেজি খাদ্যে) খাদ্যের সঙ্গে খাওয়াতে হবে তাপমাত্রা স্বভাবিক না হওয়া পর্যন্ত। এ সময় দিনের বেলায় মাছ/পোনা স্থানান্তর বন্ধ রাখতে হবে বা অত্যান্ত সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে।

লেখক: লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, ঢাকা।

কেএসকে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।