বোরো চাষে দরদি কৃষক, এ বছর সুখবরের সম্ভাবনা
*লক্ষ্যমাত্রার বেশি বীজতলা
*বীজতলায় অগ্রগতি প্রায় ১১২%
*উৎপাদন ছাড়াবে ২ কোটি ১৫ লাখ
মাসের শুরুতে ঘন কুয়াশার কারণে উত্তরাঞ্চলের কিছু এলাকায় বোরো ধানের বীজতলায় সমস্যা হয়েছে। কিন্তু দ্রুত আবহাওয়া পরিবর্তনে খুব একটা সমস্যা হয়নি। কেটে গেছে চাষিদের আশঙ্কা। বরং এর চেয়েও বড় সুখবর রয়েছে জাতীয় পর্যায়ে। লক্ষ্যমাত্রার থেকেও এ বছর বোরো ধানের বেশি বীজতলা করেছে চাষি। অর্থাৎ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি মৌসুমে বোরোর উৎপাদনও বাড়ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, এরই মধ্যে (১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত) দেশে ২ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর বীজতলা করা হয়েছে। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৪১ হাজার হেক্টর। অর্থাৎ বীজতলায় অগ্রগতি প্রায় ১১২ শতাংশ।
আরও পড়ুন: মজুরি বাড়লেও খুশি হতে পারছেন না শ্রমিক, বিপাকে বোরো চাষি
বোরো ধান চাষের মৌসুম চলছে এখন। কোথাও বীজতলা রোপণ শুরু হয়েছে, কোথাও হালি চারা তৈরি করে রোপণের অপেক্ষাও করছেন কৃষক। এ বছর সারাদেশে ৪৯ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে রোপণ হয়েছে ১২ লাখ ১৪ হাজার হেক্টরে।
তথ্য বলছে, দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৯ লাখ ৫১ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৯ লাখ টন। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ২ কোটি ১৫ লাখ টন। যদিও উৎপাদন আরও বাড়বে বলে আশা করছে কৃষি সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন: মাঘ মাসের ফসলের জন্য কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরামর্শ
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, আশা করা হচ্ছে চলতি বছর ২ কোটি ১৫ থেকে ২০ লাখ টন বোরো উৎপাদন হবে, যা অন্যান্য বছরের থেকে সর্বোচ্চ।
তিনি বলেন, ধানের দাম, উন্নত প্রযুক্তি ও বীজ এবং সরকারের বড় প্রণোদনার কারণে কৃষক বোরোর প্রতি আগ্রহী হয়েছে। তারা এ বছর দরদ দিয়ে বোরো আবাদ করছে। তাদের মধ্যে যে অনীহা অন্যান্য বছর তৈরি হতো সেটা একদমই নেই।
বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, মাঠে গিয়েছি। কোথাও কুয়াশা ছিল। কৃষক পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছে বীজতলা যেন নষ্ট না হয়। তাদের এ আন্তরিকতা বোরোতে বড় সফলতা আনবে এবার।
আরও পড়ুন: দিনাজপুরে শীতে বাধাগ্রস্ত বোরো আবাদ
সরকারও এ বছর বোরোর উৎপাদন বাড়াতে বেশ আন্তরিক। বোরো ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য চলতি মৌসুমে প্রায় ১৭০ কোটি টাকার প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। সারাদেশের ২৭ লাখ কৃষক এ প্রণোদনার আওতায় বিনামূল্যে বীজ ও সার পাচ্ছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, তিনটি ক্যাটাগরিতে দেওয়া হচ্ছে এ প্রণোদনা। হাইব্রিড ধানের উৎপাদন বাড়াতে প্রায় ৮২ কোটি টাকার প্রণোদনার আওতায় ১৫ লাখ কৃষকের প্রত্যেককে দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে দুই কেজি ধানবীজ। উচ্চফলনশীল জাতের উৎপাদন বাড়াতে প্রায় ৭৩ কোটি টাকার প্রণোদনার আওতায় উপকারভোগী কৃষক ১২ লাখ। এতে একজন কৃষক এক বিঘা জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পাঁচ কেজি বীজ, ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার বিনামূল্যে পাবেন।
কুয়াশা-শৈত্যপ্রবাহে নষ্ট হচ্ছে বোরোর বীজতলা-ছবি জাগো নিউজ
এছাড়া কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের সুবিধার্থে একটি মাঠে একই সময়ে ধান লাগানো ও কাটার জন্য ১৫ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এর আওতায় ৬১টি জেলায় ১১০টি ব্লক বা প্রদর্শনী স্থাপিত হবে। প্রতিটি প্রদর্শনী হবে ৫০ একর জমিতে, খরচ হবে ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
আরও পড়ুন: কুয়াশা-শৈত্যপ্রবাহে নষ্ট হচ্ছে বোরোর বীজতলা
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ) বলাই কৃষ্ণ হাজরা জাগো নিউজকে বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় যে কোনো উপায়ে এ বছর বোরোর উৎপাদন বাড়াতে চায়। সে কারণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বাজেট কৃষি পুনর্বাসন–সহায়তা খাত থেকে বড় প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে এসব প্রণোদনা বিতরণ কার্যক্রম প্রায় শেষ। এরই মধ্যে বীজ ও সারের জন্য বরাদ্দের প্রণোদনা বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বীজতলা প্রস্তুতের পরে এখন ইরি-বোরো ধান চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কৃষকেরা। কোথাও জমি প্রস্তুতের কাজ চলছে, কোথাও বীজতলা রোপণ, ক্ষেতে পানি দেওয়া, কোথাও ফসলে সার ছিটানোসহ নানা কাজে ব্যস্ত কৃষক।
তবে বরেন্দ্র ও চর এলাকার কৃষকেরা রয়েছেন কিছুটা দুশ্চিন্তায়। তারা বলছেন, ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বোরো আবাদ ব্যয়বহুল হয়েছে। ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ায় উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে। এতে প্রতি হেক্টরে চাষিদের সেচ ও মাড়াইয়ের জন্য গত বছরের থেকে এ মৌসুমে অতিরিক্ত খরচ গুনতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন: বোরো উৎপাদন বাড়াতে ১৭০ কোটি টাকার প্রণোদনা
নওগাঁর মান্দা সদর উপজেলার কৃষক কাদের ব্যাপারী বলেন, বোরো মৌসুমে এক হেক্টর জমিতে ১০ থেকে ১৫ বার সেচ দিতে হয়। তেলের দাম বাড়ায় একরপ্রতি সেচ খরচ ৪০০ টাকা, চাষের খরচ ৩০০ ও মাড়াইয়ে ৩০০ টাকা খরচ বেশি পড়েছে। সারসহ অন্য উপকরণের দামও চড়া।
হাঁড় কাঁপানো শীতের সকালে জমিতে চাষ দিচ্ছেন কৃষক-ছবি জাগো নিউজ
তিনি বলেন, সেজন্য বোরো আবাদ কমেনি। সবাই ধানের দাম ভালো থাকায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে খরচ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
অন্যদিকে কিছু এলাকায় এখনো শীতের কারণে বোরো আবাদ ব্যাহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে তীব্র শীতে কাঁপছে উত্তরের আরেক জেলা দিনাজপুর। বছরের শুরু থেকেই এ জেলায় চলছে শৈত্যপ্রবাহ। সেখানে এখনও কৃষক বোরো চারা রোপণের জন্য জমি প্রস্তুত করতে পারেনি। আবার অনেকের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কুয়াশায়। তাই বোরো চারা রোপণে পিছিয়ে চাষিরা।
আরও পড়ুন: মিনিকেট আছে, মিনিকেট নেই
যদিও সে বিষয়ে দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের উপ-পরিচালক মো. নূরুজ্জামান বলেন, জেলায় প্রায় সব জমি প্রস্তুত। শীত কমলেই সব কৃষক মাঠে নামবে। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই বোরো চারা রোপণে ধুম পড়ে যাবে। এ চারা ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত রোপণ সম্ভব। সে কারণে চিন্তার কিছু নেই।
এনএইচ/এসএইচএস/জেআইএম