দুর্গম চরে অর্ধশতাধিক মহিষের বাথানে স্বাবলম্বী মালিকরা

শেখ মহসীন
শেখ মহসীন শেখ মহসীন ঈশ্বরদী (পাবনা)
প্রকাশিত: ১২:৩৪ পিএম, ০৬ নভেম্বর ২০২২

পাবনার ঈশ্বরদীর দুর্গম পদ্মার চরে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশতাধিক মহিষের বাথান। চরের বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণভূমিতে মহিষ পালন করে বাথান মালিকরা এখন স্বাবলম্বী। ভোর থেকে শুরু হয় রাখাল আর ঘোষালদের কর্মযজ্ঞ। মহিষের দুধ দোয়ানো, দুধ ওজন করা, মাঠে চরানো ও রান্না করে নিজেদের খাওয়া-দাওয়াসহ নানা কাজে দিনভর ব্যস্ত থাকেন তারা।

ঈশ্বরদী শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের দুর্গম ডিগ্রীরচর ও চরভবানীপুর গিয়ে দেখা যায়, উত্তপ্ত দুপুরে পদ্মার চরের তৃণভূমিতে শত শত মহিষ ঘাস খাচ্ছে। মহিষের পাশেই ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কয়েকজন রাখাল। প্রতিটি বাথানে ১০০ থেকে ৪০০ পর্যন্ত মহিষ আছে। একজন রাখাল ৫০টি মহিষ দেখভাল করছেন।

রাখালরা দিন শেষে পলিথিন বা ত্রিপলের তাঁবুতে এসে আশ্রয় নেন। মহিষগুলো থাকে খোলা আকাশের নিচে। ভোর হলেই মহিষের দুধ সংগ্রহ শুরু করেন বাথান মালিকদের নিয়োগকৃত ঘোষালরা। তারপর ব্যবসায়ীদের তা বুঝিয়ে দিয়ে রাখাল ও ঘোষালরা একত্রিত হয়ে শুরু করেন রান্না। সকালে নাস্তার পর তারা বেরিয়ে পড়েন মহিষ চরাতে।

এভাবে প্রতিদিন একই নিয়মেই চলছে তাদের জীবনযাত্রা। বাথানের মহিষ নিয়ে এক থেকে দেড় মাস পরপরই রাখালরা স্থান পরিবর্তন করেন। রাজশাহীর বাঘা থেকে ঈশ্বরদীর ডিগ্রীর চর, কুষ্টিয়ার মিরপুরের তালবাড়িয়া চর থেকে পাবনার সদর উপজেলার চরভবানীপুর চর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ পদ্মার চরজুড়ে মহিষ চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে।

মহিষের বাথান মালিক বাবলু মন্ডল জাগো নিউজকে জানান, ১৫০টি ছোট-বড় মহিষ আছে তার বাথানে। দুজন রাখাল ও তিনি মহিষগুলো দেখভাল করেন। ২০টি মহিষ দিয়ে তিনি বাথান শুরু করেন। তিনি ২০ বছর ধরে মহিষের বাথানের সঙ্গে নদীর চরে থাকেন। পরিবারের প্রয়োজনে কখনো বাড়ি গেলে তার ছেলে থাকেন।

দুর্গম চরে অর্ধশতাধিক মহিষের বাথানে স্বাবলম্বী মালিকরা

বাথানে মহিষ পালনের অভিজ্ঞতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঝড়, বৃষ্টি আর প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে পদ্মার দুর্গম চরে দিনরাত থাকতে হয়। গ্রীষ্মের সময় প্রচণ্ড গরম হাওয়া আর শীতের সময় শৈত্যপ্রবাহ মোকাবিলা করেই থাকতে হয়। তা ছাড়া ডাকাত বা সন্ত্রাসীদের ভয় তো আছেই। যদিও সচরাচর রাতে এমন ঘটনা ঘটে না। তবে ঘটতে কতক্ষণ?’

লক্ষ্মীকুন্ডার লালগোলার চরে কথা হয় মহিষ বাথানের মালিক আব্দুল হান্নানের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাথানের মহিষ শুধু সবুজ ঘাস খেতে পছন্দ করে। বর্ষাকালে নদীর চর ডুবে গেলে এদের ধানের পোয়াল, ধানের গুড়া, সরিষার খৈল ও ভূষি খেতে দেওয়া হয়। এগুলো খেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। মহিষ অপরিচিত মানুষ দেখলে তাকিয়ে থাকে এবং ছোটাছুটি করে। নদীর চরেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। শহরের খামারে এরা থাকতে পারে না। বাথানে এখন ৫০টি মহিষ আছে। প্রতিটি মহিষের দাম ২-৩ লাখ টাকা। প্রতিবছর রাখাল ও মহিষের খাবার খরচ বাদে প্রায় ৫ লাখ টাকা লাভ হয়।’

সাঁড়া ইউনিয়নের সাহেবনগর চরের মহিষ বাথান মালিক জাহাঙ্গীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘পদ্মার চরে মহিষ নিয়ে আছি প্রায় ২০ বছর। বাড়ি বাঘা উপজেলায়। এখন ঈশ্বরদীর সাহেবনগর চরে আছি। কয়েকদিন পর লক্ষ্মীকুন্ডা চর হয়ে চলে যাবো পাবনা ও কুষ্টিয়ার মিরপুরের তালবাড়িয়া চরে। বাথানে মহিষ পালন খুবই কষ্টের। ঝড়, বৃষ্টি ও রোদের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে কোনো রকমে পলিথিন টাঙিয়ে থাকতে হয়।’

দুর্গম চরে অর্ধশতাধিক মহিষের বাথানে স্বাবলম্বী মালিকরা

তিনি বলেন, ‘সারাদিন মহিষ চড়িয়ে রাতেও মহিষের খেয়াল রাখতে হয়। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো ইদানিং চরের জমি যারা সরকারের কাছ থেকে বার্ষিক লিজে নেয়; তাদের কাছ থেকে খুব চড়া দামে লিজ নিয়ে মহিষ চরাতে হয়। চরের জমি যদি মহিষ-গরুর বাথান মালিকরা সরাসরি লিজ নিতে পারতো, তাহলে গরু-মহিষ পালনে খরচ কমে যেত।’

রাখাল নজরুল ইসলাম নজুর সঙ্গে কথা হয় লক্ষ্মীকুন্ডার কামালপুর চরে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের জীবন বেদুঈনদের মতো। কদিন এখানে তো কদিন আরেক জায়গায়। পলিথিন ও ত্রিপলের তাঁবুতে থাকতে হয়। রান্না করে খেতে হয়। এ জীবনে যেমন মজা আছে, তেমনই কষ্টও আছে। ১০ বছর বয়সে পদ্মার চরে এসেছি। গরু-মহিষের সঙ্গে কেটে গেছে ১৭ বছর।’

তিনি বলেন, ‘আমার মতো শত শত মহিষ ও গরুর রাখাল পদ্মার চরে আছে। বাথানের মহিষরা রাখালদের চোখের কথা বুঝতে পারে। চোখ দিয়ে ইশারা দিলেই বুঝে যায় এখন কোন দিকে যেতে হবে ও কী করতে হবে। মাসিক চুক্তিতে রাখালরা কাজ করেন। প্রতিমাসে রাখালদের বেতন ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।’

দুর্গম চরে অর্ধশতাধিক মহিষের বাথানে স্বাবলম্বী মালিকরা

জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের উপ-পরিচালক ডা. কাজী আশরাফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার মহিষ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র থেকে প্রজনন বীজ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ঈশ্বরদী ও পাবনার চরাঞ্চলে অসংখ্য মহিষের বাথান আছে। এসব বাথানে দেশি মহিষ বেশি। দেশি মহিষের নির্দিষ্ট কোনো জাত নেই।’

তিনি বলেন, ‘অনুন্নত জাতগুলোকে উন্নত করার জন্য এ প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে ভালো মহিষের জাতের বীজ এনে দেশীয় মহিষের জাত উন্নত করতে কাজ করছি। এ ছাড়াও মহিষের জাত ও রোগ বালাই সম্পর্কে বাথান মালিক ও খামারিদের প্রশিক্ষণসহ সচেতন করা হয়। পাশাপাশি গরু-মহিষ অসুস্থ হলে চিকিৎসা দেওয়া হয়।’

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।